বিহারে তরুণ আর জেন-জিদের ক্ষোভ কি সামলাতে পারবেন মোদি

নভেম্বরের নির্বাচন ঘিরে বিহারে ভোটের জোর প্রচারণা চলেছে। অক্টোবর মাসে তোলাছবি: এএফপি

ভারতের বিহার রাজ্যের মুজাফফরপুর জেলার বাসিন্দা ২০ বছরে অজয় কুমার চিন্তিত মুখে নিজের মুঠোফোন স্ক্রল করে যাচ্ছিলেন। তিনি সরকারি চাকরির একটি পরীক্ষায় অনিয়ম হওয়ার খবর শুনেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘেঁটে সেই খবরের সত্যতা নিশ্চিত হতে চাইছেন এই তরুণ। কারণ, সরকারি চাকরি নামের সোনার হরিণ হাতে পেতে তিনি প্রতিযোগিতামূলক ওই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।

অজয় নিম্নবর্ণের দলিত সম্প্রদায়ের তরুণ। ভারতে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের নানা সামাজিক বঞ্চনা ও ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হতে হয়। পিছিয়ে পড়া এই সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য ভারতে কোটা বা সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।

অজয়ও দলিতদের জন্য এই কোটার আওতায় একটি সরকারি চাকরি পাওয়ার আশা করেছিলেন। এ জন্য গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি সরকারি চাকরির ওই পরীক্ষা দেন। কিন্তু কয়েক দিন পর তিনি শুনতে পান, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল।

চরম হতাশ অজয় যখন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার খবর নিশ্চিত হতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোরাফেরা করছিলেন, ঠিক তখন তাঁর সামনে একটি ভিডিও আসে। ভিডিওতে তিনি দেখতে পান, তাঁর সমবয়সী শিক্ষার্থীরা তাঁর মতো একইভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা রাজ্যের রাজধানী পাটনায় বিক্ষোভ করছেন।

মুজাফফরপুর থেকে পাটনার দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। সেখানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাসে চেপে বসেন অজয়, সারা রাত ভ্রমণ করে সকালে নিজেকে হাজার হাজার তরুণ বিক্ষোভকারীর মধ্যে দেখতে পান।

তারপর প্রায় ১০০ দিন হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে সড়কে বিক্ষোভ করে গেছেন অজয়। প্রায় সময়ই তিনি খোলা আকাশের নিচে অন্য শত শত শিক্ষার্থীর সঙ্গে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়েছেন। তাঁদের দাবি ছিল সোজা—নতুন করে পরীক্ষা নেওয়া হোক।

কিন্তু এ বছরের এপ্রিলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট শিক্ষার্থীদের পুনঃ পরীক্ষার দাবিতে করা পিটিশনটি খারিজ করে দেন।

রাগে-ক্ষোভে ফুঁসে ওঠা অজয় কয়েক মাস ধরে নিজের ক্রোধ চেপে ছিলেন। নভেম্বরে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে এই তরুণ নিজের রাগ উগরে দেন। গত ৬ নভেম্বর দুই ধাপের নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন অজয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) বোতাম এত জোরে চেপে ধরেন যেন তাঁর ভোট তাঁর ও তাঁর মতো ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের লড়াইয়ের প্রতিশোধ নিতে সহায়তা করতে পারে।

চরম হতাশ অজয় যখন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার খবর নিশ্চিত হতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোরাফেরা করছিলেন, ঠিক তখন তাঁর সামনে একটি ভিডিও আসে। ভিডিওতে তিনি দেখতে পান, তাঁর সমবয়সী শিক্ষার্থীরা তাঁর মতো একই রকমভাবে রাগান্বিত হয়ে আছেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা রাজ্যের রাজধানী পাটনায় বিক্ষোভ করছেন।

চাকরি-শিক্ষা নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা

পুষ্টি, শিশু মৃত্যুহার, শিক্ষা, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবাসহ ভারতের বহুমাত্রিক মানব উন্নয়ন সূচকের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সারা দেশের মধ্যে বিহারের অবস্থান তলানিতে।

২০ বছর বয়সী প্রথম কুমার দক্ষিণ বিহারের জেহানাবাদ জেলার বাসিন্দা। তাঁর বাড়ি যে শহরে, সেখানে কলেজগুলো ‘শুধু ডিগ্রি দেয়, শিক্ষা নয়’। এ কারণে লেখাপড়া করতে তিনি রাজধানী পাটনায় চলে আসতে বাধ্য হন।

কিন্তু পাটনায়ও কুমারের জন্য লেখাপড়া করা কঠিন হয়ে গেছে, বলেন এই তরুণ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা নেই, ওয়াই-ফাই রাউটার মাসের পর মাস অকেজো পড়ে থাকে। তাঁর মতো শিক্ষার্থীদের প্রায়ই তাঁদের ছাত্রাবাসের সংকীর্ণ মাঠের ঘাস কাটতে হয়। কারণ, এসব কাজের জন্য পর্যাপ্ত কর্মী নেই।

ক্ষোভের সঙ্গে এই তরুণ বলেন, ‘বিহারের সবখানেই শিক্ষার মান এতটাই খারাপ যে কেবল কাগজে ডিগ্রি পেতে কলেজে ভর্তি হওয়া যায়। কিন্তু যদি সত্যিই কিছু শিখতে চান, তবে অতিরিক্ত অর্থ খরচে প্রাইভেট কোচিং ক্লাসে ভর্তি হতে হয়।’

তাই প্রথমবারের মতো কুমার নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে চাইছেন। বিহারের লাখ লাখ ছাত্র ও বেকার তরুণের সামনে এটাই একমাত্র বিকল্প।

বিহারে নভেম্বরের বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে বিজেপির ভোটের প্রচারণা। অক্টোবর মাসে তোলা
ছবি: রয়টার্স

মুম্বাইভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন সায়েন্সেসের (আইআইপিএস) ২০২০ সালে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিহারের অর্ধেকের বেশি পরিবার তাদের স্বজনদের পাঠানো অর্থের ওপর নির্ভরশীল, যাঁরা কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে বা বিদেশে চলে গেছেন।

প্রথম কুমারের বন্ধু ইশান্ত কুমার। ইশান্ত বিহারের আরেক জেলা দরভঙ্গার বাসিন্দা। উন্নত জীবনের আশায় তরুণদের দলে দলে বিহার ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে তিনি বিহারি তরুণদের ওপর ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, ভারতের অন্যান্য রাজ্যে প্রায়ই বিহারিদের ওপর আক্রমণ হয়, তাঁদের হামলার শিকার হতে হয়।

তীব্র ক্ষোভ নিয়ে ইশান্ত আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এখানে দারিদ্র্য তরুণ বিহারিদের প্রবাসে যেতে বাধ্য করে আর সেখানে তাঁদের অবমাননার শিকার হতে হয়, আঘাত করা হয় এবং তাঁদের মর্যাদা বলে আর কিছু থাকে না। কলকাতা থেকে মহারাষ্ট্র, কেবল বিহারিরাই আক্রমণ আর উপহাসের শিকার হন।’

ইশান্ত রাজ্য সরকারের ওপরও ক্ষুব্ধ। তিনি মনে করেন, রাজ্য সরকার থেকে যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে বিহারি তরুণেরা প্রবাসে চলে যাচ্ছেন। আর তাঁদের রক্ত ঘাম করা পরিশ্রমে অন্যান্য রাজ্যের উন্নতি হচ্ছে।

বিহারের সবখানেই শিক্ষার মান এতটাই খারাপ যে কেবল কাগজে ডিগ্রি পেতে কলেজে ভর্তি হওয়া যায়, কিন্তু যদি সত্যিই কিছু শিখতে চান, তবে অতিরিক্ত অর্থ খরচে প্রাইভেট কোচিং ক্লাসে ভর্তি হতে হয়।...
প্রথম কুমার, বিহারের শিক্ষার্থী

বিহারের জেন-জিরা কোন পথে

জেন-জি প্রজন্মের তরুণদের তুমুল বিক্ষোভের মুখে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে সরকার উৎখাত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারত ব্যতিক্রম। ২০১৪ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের ক্ষমতায় আছে দেশটির হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।

মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে বিহারেও গত দুই দশকে বেশির ভাগ সময় বিজেপি ও তার অংশীদারদের জোট সরকার ক্ষমতায় রয়েছে।

কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দল ক্ষমতায় থাকলেও বিহারে তরুণদের ক্ষোভ স্পষ্ট। বিহারের পাশেই ভারতের প্রতিবেশী দেশ নেপাল। সেখানে গত সেপ্টেম্বরে তরুণদের তুমুল বিক্ষোভে সরকারের পতন হয়। নেপালের তরুণেরা সম্পদের অসমবণ্টন, বৈষম্য, সরকারের দুর্নীতি এবং প্রভাবশালীদের সম্পদের কুৎসিত প্রদর্শনের বিরুদ্ধে ওই বিক্ষোভ করেছিলেন।

ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে বিহারেই সবচেয়ে বেশি তরুণের বাস। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বিহারে ১২ কোটি ৮০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৪০ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে, আর প্রায় ২৩ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে।

ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে বিহারেরই সবচেয়ে বেশি তরুণদের বাস। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বিহারে ১২ কোটি ৮০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৪০ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে আর প্রায় ২৩ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে।

ভারতে মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশও তরুণ। দেশটিতে ১৪৫ কোটি মানুষের মধ্যে ৬৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের কম।

তবে বিহারে তরুণদের সংখ্যা যেমন বেশি, একই সঙ্গে এটি ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যগুলোর একটি।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিহারে প্রতি তিনটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, যা বিহারকে ভারতের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত রাজ্য হিসেবে পরিচিত করেছে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বিহারে ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৪০০টি ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছে, সারা দেশের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।

অজয়ের মতো অনেকেই নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। বিহারে দুই ধাপে প্রায় ৭ কোটি ৮০ লাখ ভোট দিয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপের ভোট ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। রাজ্যের বিধান সভা ২৪৩ সদস্যের।

আগামীকাল ১৪ নভেম্বর বিহারে ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে।

‘এখানে দারিদ্র্য তরুণ বিহারিদের প্রবাসে যেতে বাধ্য করে আর সেখানে তাঁদের অবমাননার শিকার হতে হয়, আঘাত করা হয় এবং তাঁদের মর্যাদা বলে আর কিছু থাকে না। কলকাতা থেকে মহারাষ্ট্র, কেবল বিহারিরাই আক্রমণ আর উপহাসের শিকার হন।’

দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যেভাবে তরুণ প্রজন্ম তাদের নিপীড়ক শাসকের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিহার নির্বাচনের ফলাফল ইঙ্গিত দেবে যে মোদি এখনো ভারতে জনগণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ যুবসমাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্ষম আছেন কি না।

নাকি রাজ্যে মোদিদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টি বিহারের ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে যুবসমাজের এ অসন্তোষকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে।

আরজেডির নেতৃত্ব দিচ্ছেন লালু প্রসাদ যাদবের ছেলে তেজস্বী যাদব। কংগ্রেস পার্টির রাহুল গান্ধীও অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা, তাঁর বয়স ৫৫ বছর।

বিহারে এবার দলের পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন মোদি।

মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আবার ক্ষমতায় এলে তারা বিহারে এক কোটি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।

অন্যদিকে বিরোধী ইন্ডিয়া ব্লকের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী প্রস্তাব হলো, তারা ক্ষমতায় আসার ২০ দিনের মধ্যে প্রতিটি বিহারি পরিবারের জন্য একটি সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা দেওয়া।

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির নেতা রাহুল গান্ধীও বারবার জেন-জি ভোটারদের প্রতি ‘সতর্ক থাকার’ আহ্বান জানিয়েছেন।

গত কয়েক বছরে ভোটদানের প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম হয়েছে অভিযোগ করে রাহুল সেগুলো প্রতিহত করার আহ্বানও জানিয়েছেন।

রাহুল গান্ধীর অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দল বিজেপি দেশের ভোটার তালিকায় অযোগ্য ও মিথ্যা ভোটার যোগ করে ভোট জালিয়াতি করছে।

আরও পড়ুন