পাঞ্জাবে আবার কেন মাথাচাড়া দিয়েছে খালিস্তান আন্দোলন
ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘খালিস্তান’ আন্দোলন নতুন করে গতি পেয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা আইনে সন্দেহভাজন শতাধিক খালিস্তানপন্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে চার নেতাকে বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানে করে রোববার সন্ধ্যায় আসামে নেওয়া হয়েছে। ডিব্রুগড়ে বিশেষ নিরাপত্তায় কারাগারে আছেন তাঁরা।
কেন তাঁদের আসামে আনা হলো এ প্রশ্নে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছেন, ‘এটা দুই রাজ্যের পুলিশের বিষয়। অনেক সময় আসামে গ্রেপ্তার আসামিকে নিরাপত্তার স্বার্থে বিহারে পাঠানো হয়। তেমনি পাঞ্জাব পুলিশ সেখানকার বন্দীদের কয়েক দিনের জন্য আসামে রাখার কথা ভেবেছে। এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই।’
পাঞ্জাব পুলিশ বলছে, রাজ্যে নতুন করে গতি পাওয়া খালিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শিখ নেতা অমৃতপাল সিং। তাঁর চার সহযোগীকে গতকাল গ্রেপ্তার করা হয়। তবে অমৃতপালকে ঘিরে পুলিশ ফেললেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। সোমবার বিকেল পর্যন্ত সন্দেহভাজন অন্তত ১১২ খালিস্তানপন্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আন্দোলনে নতুন গতি
পাঞ্জাবে সম্প্রতি নতুন করে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং স্বাধীনতাকামী খালিস্তান আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’ নামের একটি সংগঠন, যাঁর নেতৃত্বে আছেন অমৃতপাল সিং। নতুন করে খালিস্তান আন্দোলন গতি পাওয়ায় চার দিন ধরে অমৃতপালকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে পুলিশ।
এ নিয়ে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। রাজ্যের অন্তত আট জেলায় মানুষ বিক্ষোভ দেখিয়েছেন এবং পথে নেমেছেন। বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স নামানো হয়েছে। তাদের সহায়তা করছে কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী। সরকারি নজরদারির ভয়ে সাধারণ লোকজন মুঠোফোনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।
এমন অভিযোগ একটি কৃষক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত একজন নেতার। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপরে নজরদারি করছে সরকার। স্থানীয় লোকজনও এমন অভিযোগ করেন। এ ছাড়া রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনী ফ্ল্যাগ মার্চ করছে বলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
খালিস্তান আন্দোলন প্রতিরোধে রাজ্যে প্রথমে ইন্টারনেট পরিষেবা সোমবার পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। পরিষেবা বন্ধ রাখার মেয়াদ মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, যেহেতু অমৃতপালকে এখনো ধরা যায়নি, তাই নানা ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। আর এ কারণেই ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে।
এখন কেন
অমৃতপাল ও ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে সম্পর্কে যেসব তথ্য জানায় যায়, তা এসেছে স্থানীয় গণমাধ্যমে অমৃতপালের দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। একাধিক বিষয়ে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অমৃতপালের দাবি, আশির দশক থেকে কয়েক লাখ মানুষকে আসামে ভুয়া ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা করা হয়েছে। মানুষ এই গণহত্যার কারণে চূড়ান্ত হতাশাগ্রস্ত। অনেকটা সেই কারণে রাজ্যে মাদকাসক্তি বেড়েছে এবং মাদকাসক্তি রোধ করতেই তিনি পথে নেমেছেন।
২০২০ সালে কৃষক আন্দোলন–পরবর্তী সময়ে পাঞ্জাবে দীপ সিধু নামে এক নতুন নেতা উঠে আসেন। গত বছর দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, একসময় বিজেপিঘনিষ্ঠ সিধু খালিস্থান আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। অমৃতপালের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। অনেকটা এ কারণেই পরবর্তী সময়ে দুবাই থেকে ভারতে ফিরে তিনি ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে সংগঠনটির দায়িত্ব নেন। অমৃতপালের পরিবার অবশ্য দাবি করছে যে দীপ সিধুর সঙ্গে অমৃতপালের যোগাযোগ ছিল না।
অমৃতপাল তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দীর্ঘ সময় ধরে ভারতে শিখ ধর্মাবলম্বীদের অপমান করা হচ্ছে এবং তাঁদের চুল এবং দাড়ি কাটতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। শিখ ধর্মকে ধীরে ধীরে ‘শেষ’ করে দেওয়ার পাশাপাশি পাঞ্জাবের আরও একাধিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না কেন্দ্রীয় সরকার।
এক সাক্ষাৎকারে অমৃতপাল বলেছেন, ‘পাঞ্জাব চিরকালই ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের কাছে ক্রীতদাস হয়ে থাকতে পারে না।’ অবিলম্বে পাঞ্জাবের স্বাধীনতা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেছেন এই শিখ নেতা। তিনি বলেন, ‘১৯৮৪ সালে আমরা যদি স্বাধীনতা পেতাম, তাহলে আজ পাঞ্জাবের অবস্থা ভারতের মতো হতো না।’
কারণ কী
ভারতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা নতুন করে খালিস্তান আন্দোলন মাথাচাড়া দেওয়ার নেপথ্যে পাকিস্তানের দায় দেখছেন। তাঁদের মতে, আশির দশকে পাঞ্জাবে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও স্বাধীনতাকামী খালিস্তান আন্দোলন হয়েছিল, সেই আন্দোলন আবার উসকে দিতেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) নতুন করে উদ্যোগী হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে আইএসআই ‘খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল’ অমৃতপাল সিংকে ভারতে পাঠিয়েছে।
এদিকে ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো অবশ্য এর পেছনে আরও দুজনের হাত আছে বলে ধারণা করছে। বলা হচ্ছে, যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী খালিস্তানি নেতা অবতার সিং খান্দা আছেন পুরো পরিকল্পনায়। আর খালিস্তানি নেতা জগতার সিং তাঁর নতুন আন্দোলনের প্রধান মস্তিষ্ক।
ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ অবশ্য এর পেছনে ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী তৎপরতার দায় দেখছেন। তাঁদের মতে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সংখ্যালঘু সমাজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সেই নিরাপত্তাহীনতারই প্রকাশ ঘটেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অহিংস ও সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাঞ্জাবে নতুন করে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, এটাকে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া বলেও ব্যাখ্যা করেছেন অনেকেই।
‘দ্বিতীয় ভিন্দ্রাওয়ালে’
পাঞ্জাবের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো ইতিমধ্যে অমৃতপাল সিংকে ‘দ্বিতীয় ভিন্দ্রাওয়ালে’ আখ্যা দিয়ে তরুণদের মধ্যে তার প্রবল জনপ্রিয়তার বিষয় মেনে নিয়েছে। এটা সরকারের বিশেষ চিন্তার বিষয়। কারণ, ১৯৮০ সালের পরবর্তী সময়ে খালিস্তানি নেতা জার্নেল সিং ভিন্দ্রাওয়ালে ‘পৃথক রাষ্ট্র’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
ভারতীয় রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও সামরিক বিশ্লেষকেরা পরবর্তী সময়ে দেখিয়েছেন কীভাবে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেস এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল পাঞ্জাবে ক্ষমতা দখল করতে। আন্দোলনের শেষ ধাপে ‘অপারেশন ব্লু স্টারের’ মাধ্যমে ভারতের সেনাবাহিনী ভিন্দ্রাওয়ালেকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। এরই প্রতিক্রিয়ায় শিখ জঙ্গিদের হামলায় ১৯৮৪ সালে নিহত হয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
আশির দশকের একটি ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ যে সে সময় আন্দোলনের শেষ মুহূর্তে হলেও শিখ সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় সংস্থা অকাল তখতের সমর্থন ভিন্দ্রাওয়ালে পেয়েছিলেন। এবার অমৃতপালও কিছুটা সমর্থন পেয়েছেন অকাল তখতের। অকাল তখতের জাঠেদার বা প্রধান জ্ঞানী হরপ্রীত সিং বলেছেন, ‘পাঞ্জাব বহু কষ্ট সহ্য করেছে। পাঞ্জাবের ক্ষতে প্রলেপ দিতে আসেনি কোনো সরকার। আর শিখ তরুণদের বিদ্বেষের শিকার হতে হয়েছে। সরকার যেন আগের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়।’