মোদির ‘ম্যাচ পাতানো’, ইন্ডিয়া জোটের গণতন্ত্র বাঁচানোর আহ্বান

ইন্ডিয়া জোটের জনসভা মঞ্চে (ডান থেকে) কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের স্ত্রী সুনিতা কেজরিওয়াল ও ঝাড়খন্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনা সোরেন। নয়াদিল্লি, ভারত, ৩১ মার্চছবি: এএনআই

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনকে ‘স্বৈরতন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে লোকসভা ভোটে তাঁর বিচারধারাকে হারানোর হাঁক দিলেন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতারা। লোকসভা ভোট শুরুর ঠিক ১৯ দিন আগে রোববার রাজধানী নয়াদিল্লির রামলীলা ময়দানে আয়োজিত বিশাল জনসভায় তাঁরা বললেন, দেশ এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি। সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে হাতিয়ার করে দেশকে বিরোধী দলশূন্য করার খেলায় মেতেছে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি। একজোট হয়ে এর মোকাবিলা করাই এখন সময়ের দাবি। না হলে দেশ রসাতলে যাবে।

জনসভায় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, এটা নিছক ভোট দেওয়ার নির্বাচন নয়, এটা গণতন্ত্র বাঁচানোর নির্বাচন। ক্রিকেটের পরিভাষা ব্যবহার করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি ইডি, আয়কর, সিবিআইয়ের সাহায্যে ম্যাচ পাতাতে চাইছেন। ভোট শুরুর আগেই মুখ্যমন্ত্রীদের জেলে পুরছেন। কংগ্রেসের ব্যাংক হিসাব জব্দ করছেন। তিনি বিরোধীদের চান না। ভেবেচিন্তে ভোট না দিলে ম্যাচ গড়াপেটার নায়ক কিন্তু জিতে যাবে।

ভোটে কারচুপির সন্দেহ প্রকাশ অবশ্য আরজেডির নেতা তেজস্বী যাদবও করেছেন। তাঁর কথায়, যেভাবে ওরা ৪০০ পারের কথা বলতে শুরু করেছে, তাতে ইভিএমে কারচুপি করবে বলে সন্দেহ হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের এমন একজনও নেই, যার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ওরা করেনি। আমরা কিন্তু ভয় পাই না।’ মোদির গ্যারান্টিকে তিনি চীনা পণ্যের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, দুই দিনেই খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো। একটা গ্যারান্টিও তিনি আজ পর্যন্ত রাখতে পারেননি।    

এই জনসভাকে কংগ্রেস কতটা গুরুত্ব দিয়েছে, বোঝা যায় নেতাদের উপস্থিতি দেখলে। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন রাহুল, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, জয়রাম রমেশ ও দিল্লির শীর্ষ নেতারা। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীও জনসভায় উপস্থিত হন। তিনি মঞ্চে বসেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের স্ত্রী সুনীতা কেজরিওয়ালের পাশে। সবার ভাষণ শেষ হলে প্রিয়াঙ্কা সবাইকে মনে করিয়ে দেন, রাবণের কাছে সব ছিল। রাজত্ব, অর্থ, লোকবল, শক্তি—সব। রামচন্দ্রের কাছে ছিল শুধু সত্য, সাহস ও ধৈর্য। লড়াইয়ে রামচন্দ্রেরই জয় হয়েছিল। রাবণের মতো মোদির অহংকারও চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়বে। এটাই রামলীলা ময়দানের বার্তা।  

জোট গঠন হওয়ার পর এটি ছিল ইন্ডিয়া জোটের তৃতীয় জনসভা। প্রথমটি হয়েছিল বিহারের রাজধানী পাটনায়। দ্বিতীয়টি মুম্বাইয়ে। তৃতীয় জনসভার আয়োজন সেই সময় যখন ইন্ডিয়া জোটের দুই শরিক আম আদমি পার্টির দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রোববারের জনসভার অন্যতম প্রধান আকর্ষণও ছিলেন দুই বন্দী মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী—সুনীতা কেজরিওয়াল ও কল্পনা সোরেন। দুজনেই এই প্রথম জনসভায় রাজনৈতিক ভাষণ দিলেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে দুজনেই রাজনৈতিক দায়িত্ব নেবেন কি না, সেই জল্পনা কদিন ধরেই চলছে। রামলীলা ময়দানের জনসভার পর সেই জল্পনা জোরালো হতে বাধ্য।

নয়াদিল্লির রামলীলা ময়দানে আয়োজিত ইন্ডিয়া জোটের জনসভা মঞ্চে (বাঁ থেকে) কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী বলবন্ত সিং মান ও জম্মু–কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ফারুক আবদুল্লাহ। ভারত, ৩১ মার্চ
ছবি: এএনআই

  এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, জোটবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ইন্ডিয়া জোট এত দিন সেভাবে দানা বাঁধেনি। রাজ্যে রাজ্যে শরিক দলের মধ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে বোঝাপড়াও সর্বত্র হয়ে ওঠেনি। তা সত্ত্বেও রোববারের রামলীলা ময়দানের সমাবেশ সবকিছুকে ছাপিয়ে ওঠে। ভোট তফসিল ঘোষণার ঠিক আগে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন, ঘোষণার পর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার, কংগ্রেসকে একটার পর একটা আয়কর নোটিশ পাঠানো, জেলের ভয় দেখিয়ে বিরোধীদের দলত্যাগ করানো এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নির্বাচনী বন্ডের স্বরূপ উদ্‌ঘাটন হওয়া বিরোধীদের আরও বেশি করে জোটবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়েছে। সেই কারণে সব শরিক দলের শীর্ষ নেতারা রোববার দুপুরের তীব্র গরম উপেক্ষা করে উপস্থিত থেকেছেন ঐতিহাসিক রামলীলা ময়দানে।

শরিক নেতাদের মধ্যে হাজির ছিলেন না শুধু দুজন। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন ও পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুজনেই ভোট প্রচারে ব্যস্ত। তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে তিরুচি শিবা ও ডেরেক ও’ব্রায়েন। মমতার বার্তা পাঠ করে ডেরেক জানান, তৃণমূল কংগ্রেস দৃঢ়ভাবে ইন্ডিয়া জোটে রয়েছে। জম্মু-কাশ্মীর থেকে এসেছিলেন ফারুক আবদুল্লাহ, মেহবুবা মুফতি, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী বলবন্ত সিং মান, এনসিপির শারদ পাওয়ার, শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে ও সঞ্জয় রাউত, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব, ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী চম্পাই সোরেন, আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব, সিপিআইয়ের ডি রাজা, সিপিআইএমএলের দীপংকর ভট্টাচার্য এবং দিল্লির আম আদমি পার্টির মন্ত্রীরা। মঞ্চে বিশাল ব্যানারে লেখা ছিল ‘স্বৈরতন্ত্র হটাও, গণতন্ত্র বাঁচাও’। এই ব্যানারের সঙ্গে পোডিয়ামের মাঝখানে রাখা ছিল জেলখানায় বন্দী কেজরিওয়ালের একটি ছবিও। যদিও জনসভা শুরুর আগে ওই ছবি সরিয়ে নেওয়া হয়। ইন্ডিয়া জোটের নেতারা এমন বার্তা দিতে চাননি যে শুধু কেজরিওয়ালের মুক্তির দাবিতেই এই জনসভা। দুপুর ১২টায় জনসভা শুরুর অনেক আগেই রামলীলা ময়দানে নেতা-কর্মীদের উপচেপড়া ভিড় ছিল। সমাবেশে সব দলের পতাকা দেখা গেলেও আম আদমি পার্টির উপস্থিতি ছিল বেশি।  

কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারের পর তাঁর স্ত্রী সুনীতা বেশ সক্রিয়। স্বামীর একটি বার্তা তিনি জনসভায় পাঠ করেন, যেখানে বন্দী মুখ্যমন্ত্রী ইন্ডিয়া জোটের সাফল্য কামনার পাশাপাশি ৬টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বলেছেন, ইন্ডিয়া জোট জিতলে সারা দেশের সর্বত্র ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ, গরিবদের জন্য বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ, সর্বত্র সবার জন্য উন্নত স্কুল, সবার জন্য মহল্লা ক্লিনিক ও উন্নত হাসপাতাল, কৃষকদের জন্য স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হবে। বার্তা পাঠের আগে সুনীতা জনতার কাছে জানতে চান, কেজরিওয়ালের ইস্তফা দেওয়া উচিত কি না। জনতার রায় ছিল নেতিবাচক। সুনীতা বুঝিয়ে দিলেন, তেমন হলে স্বামীর ছেড়ে যাওয়া জুতায় পা গলাতে তিনি প্রস্তুত।

কারাবন্দী হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনাও তাঁর স্বামীর হয়ে জানিয়ে দেন, ভগবান রামচন্দ্র চিরকাল নীতির কথা বলেছেন। ইন্ডিয়া জোট সেই নীতি প্রতিষ্ঠা করবে। ঝাড়খন্ড মাথা নোয়াবে না। ইন্ডিয়া মাথা ঝোঁকাবে না।

মেহবুবা মুফতি বলেন, স্বৈরতন্ত্রের স্বরূপ দেখতে হলে কাশ্মীরে আসতে হবে। আইন কী, কানুন কী, গণতন্ত্র কী—আমরা জানি না। জম্মু-কাশ্মীর বিজেপির স্বৈরাচার ও যথেচ্ছাচারের গবেষণাগার।

আরও পড়ুন