ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে ২২ এপ্রিলের হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে উভয় দেশের তরফে একগুচ্ছ পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ গ্রহণ করার ঘোষণায় এক বড় সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকের পর গত বুধবার দেশটি জানিয়েছে, তারা ছয় দশকের পুরোনো সিন্ধু পানিচুক্তি (আইডব্লিউটি) স্থগিত করছে। গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তির মাধ্যমেই সিন্ধু অববাহিকার অভিন্ন নদ-নদীর পানি দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করা হয়ে থাকে। চুক্তিটি উভয় দেশের জন্য বিশেষ গুরুত্ববহ। চুক্তিটি স্থগিত করা ছাড়াও পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ, বাণিজ্য স্থগিত, পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা বাতিল ও ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানি কূটনীতিকদের সংখ্যা কমানোরও ঘোষণা দিয়েছে নয়াদিল্লি।
জবাবে পাকিস্তানের শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক সিদ্ধান্তগ্রহণকারী সংস্থা ‘জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (এনএসসি)’ একই ধরনের পাল্টা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ও আকাশপথ বন্ধ এবং বাণিজ্য স্থগিত করা। দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাল্টা পদক্ষেপ হলো, ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, বিশেষ করে সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসার হুমকি।
১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করেছে। এ চুক্তি অনুযায়ীই বিতর্কিত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) পরিচালিত হয়। তা ছাড়া দুই দেশের মধ্যে বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিতে প্রতিশ্রুতির রূপরেখা দেওয়া হয়েছে এ চুক্তিতে।
নয়াদিল্লির পদক্ষেপের জবাবে পাকিস্তানের শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক সিদ্ধান্তগ্রহণকারী সংস্থা ‘জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি’ একই ধরনের পাল্টা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ও আকাশপথ বন্ধ ও বাণিজ্য স্থগিত করা। দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাল্টা পদক্ষেপ হলো, ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, বিশেষ করে সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসার হুমকি।
এখন এ চুক্তি স্থগিত করার পাকিস্তানের হুমকি সম্ভাব্য গুরুতর উত্তেজনারই ইঙ্গিত। কিন্তু সিমলা চুক্তি আসলে কী এবং এটি থেকে পাকিস্তান বেরিয়ে এলে কী প্রভাব পড়বে, সেটি এক বড় প্রশ্ন।
সিমলা চুক্তি কী
একাত্তরের যুদ্ধের সাত মাস পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলায় সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সঙ্গে এ যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়। ভারত এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল।
শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিভিন্ন বিরোধের নিষ্পত্তি করা এবং কাশ্মীরসহ নানা ইস্যুর দ্বিপক্ষীয় সমাধান ছিল ১৯৭২ সালের ২ জুলাই স্বাক্ষরিত এ চুক্তির মূল বিষয়গুলোর অন্যতম।
এটি (সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া) নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই দেশের অবস্থানগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে চুক্তির অধীন সেখানে শান্তি বজায় রয়েছে। কিন্তু যখন কোনো চুক্তি থাকবে না, তখন দুই দেশ অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে উৎসাহিত হতে পারে।
এ ছাড়া এ চুক্তিতে আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করাকে শ্রদ্ধা দেখানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলের একটি ছিল, ‘সিজফায়ার লাইনের’ (যুদ্ধবিরতি রেখা) নাম পাল্টে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ (নিয়ন্ত্রণরেখা) করা। উভয় দেশ এটিকে একতরফা পরিবর্তন না করার অঙ্গীকার করে। এ ছাড়া চুক্তির ফলে একাত্তরের যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী মুক্তি দেয় ভারত।
চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, ‘দুই দেশের মধ্যে কোনো সমস্যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উভয় পক্ষ কোনো একতরফা পদক্ষেপ নেবে না এবং উভয়েই শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর কোনো কর্মকাণ্ড সংগঠিত করবে না কিংবা তাতে সহায়তা বা উত্সাহ দেবে না।’
পাকিস্তানের হুমকি কেন গুরুত্বপূর্ণ
সিমলা চুক্তিকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন, কিন্তু দুই দেশের মধ্যকার খুব গুরুত্বপূর্ণ রূপরেখা বলে আখ্যায়িত করেন আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞ ও পাকিস্তান সরকারের সাবেক আইন উপদেষ্টা আহমের বিলাল সুফি। তিনি বলেন, ‘চুক্তি স্থগিত করার জন্য পাকিস্তানকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা করতে হবে, যেন এটি নিশ্চিত হয় যে ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক এ পদক্ষেপ নেওয়া হলে দেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে।’
১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করেছে। এ চুক্তি অনুযায়ীই বিতর্কিত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) পরিচালিত হয়। তা ছাড়া দুই দেশের মধ্যে বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিতে প্রতিশ্রুতির রূপরেখা দেওয়া হয়েছে এ চুক্তিতে।
আহমের বিলাল আল–জাজিরাকে আরও বলেন, ‘(ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে) কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অবশ্যই খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ মুশতাক আহমদ নামের শিফা তামির-ই-মিল্লাত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, ভারত দীর্ঘদিন ধরে সিমলা চুক্তিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে।
বিষয়টির ব্যাখ্যায় মুশতাক আহমেদ বলেন, ‘ভারতের অবস্থান হলো, এ চুক্তি কাশ্মীরকে নিখাঁদ দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে পরিণত করেছে। ফলে এখানে কোনো আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার দরকার নেই।’
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ভারত-পাকিস্তান বিবাদের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে আছে হিমালয়ের এ অঞ্চল। উভয় দেশ কাশ্মীরের অংশবিশেষ নিয়ন্ত্রণ করলেও দুই পক্ষই এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবিদার। দেশ দুটি চারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে, যার তিনটিই ছিল কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে।
পাকিস্তান মনে করে, কাশ্মীর ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলো একটি কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দেয়। সিমলা চুক্তি এটিকেই পুনর্ব্যক্ত করে।
ভারত নিজের স্বার্থে ঐতিহাসিকভাবে সিমলা চুক্তির ‘অপব্যবহার’ করেছে।
তবে ২০১৯ সালে ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা জম্মু ও কাশ্মীরের আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা কেড়ে নেয় মোদি সরকার। পাকিস্তানের অভিযোগ, এর মাধ্যমে নয়াদিল্লি সিমলা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।
ইসলামাবাদ এখন সিমলা চুক্তি থেকে তার সরে যাওয়ার পেছনে ভারতের ওই অবস্থানকে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পারে বলে মনে করেন আহমেদ। তিনি আরও বলেন, ল’ অব ট্রিটিস–সংক্রান্ত ভিয়েনা সনদ অনুযায়ী (পাকিস্তান স্বাক্ষরকারী, ভারত নয়), যদি কোনো পক্ষ চুক্তি লঙ্ঘন করে, তবে অন্য পক্ষ সেই চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে।
অবশ্য ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা বলেন, সিমলা চুক্তি থেকে কোনো এক পক্ষ বা উভয় পক্ষ বেরিয়ে গেলে, তার অর্থ হবে, নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে (ভারত-পাকিস্তান) ‘কেউ কিছু মানতে বাধ্য থাকবে না’।
এই বিশ্লেষক আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এটি (সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া) নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই দেশের অবস্থানগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে চুক্তির অধীন সেখানে শান্তি বজায় রয়েছে। কিন্তু যখন কোনো চুক্তি থাকবে না, তখন দুই দেশ অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে উৎসাহিত হতে পারে।’
সিমলা চুক্তি স্থগিত করা কি যুদ্ধ ঘোষণা শামিল
শিমলা চুক্তি বিদ্যমান থাকার পরও ভারত ও পাকিস্তান একাধিকবার সংঘাতে জড়িয়েছে, যেমন বিশ্বের সবচেয় উঁচু যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত সিয়াচেন হিমবাহের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া নিয়ে দুই দেশের চার দশক স্থায়ী সংঘর্ষ ও ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ।
আহমেদ বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এলওসি কখনো দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আনতে পারেনি।
পাকিস্তানের সংবিধান বিশেষজ্ঞ রিদা হোসেন যুক্তি দেন, ভারত নিজের স্বার্থে ঐতিহাসিকভাবে এই চুক্তির ‘অপব্যবহার’ করেছে।
রিদা হোসেন বলেন, ‘সিমলা চুক্তির মূলকথা হলো, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। কিন্তু সম্প্রতি যুদ্ধের উসকানিমূলক ভারতীয় বক্তব্য ও প্রমাণ ছাড়াই (পেহেলগাম) হামলার জন্য (পাকিস্তানকে) দোষারোপ অন্যকিছু নির্দেশ করে।’
উল্লেখ্য, পাকিস্তান ভারতের অভিযোগ নাকচ করে তার বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ হাজির করার দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে আহ্বান জানিয়েছে কাশ্মীর হামলা নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের।
ভারতের সাবেক সেনা কর্মকর্তা শুক্লা বলেন, ‘পাকিস্তান সিমলা চুক্তি বাতিল করলেও সেটি সরাসরি যুদ্ধ শুরুর শামিল হবে না। কিন্তু তা দুই প্রতিবেশীকে সম্ভাব্য যুদ্ধের কাছাকাছি নিয়ে যাবে।’
মুশতাক আহমদ বলেন, ভারতের সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করাও আন্তর্জাতিক আইনে আগ্রাসী পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হতে পারে। এর ফলে পাকিস্তান আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিতে পারে।
মুশতাক আরও বলেন, সিন্ধু পানিচুক্তি পাকিস্তানের প্রায় ২৫ কোটি মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর স্থগিতকরণ একটি বৈরী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পাকিস্তানের হুমকিকে দেশটির সরকারের একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটি ভারতকে পাকিস্তানের তরফে এক সতর্কবার্তা।’