লোকসভা ভোটে গুরুত্বপূর্ণ যেসব দল ও প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে

নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, রাহুল গান্ধী ও কেজরিওয়াল

বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক চর্চা হিসেবে ধরা হয় ভারতের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানকে। আজ শুক্রবার শুরু হয়েছে সাত দফার অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট গ্রহণ। এবারের নির্বাচনে যোগ্য ভোটার প্রায় ১০০ কোটি। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার হিসাবে এটি প্রতি আটজনে একজন।

আগামী পাঁচ বছরের জন্য সংসদে কোন দল ও প্রার্থীরা বসবেন, তা বাছাইয়ে শুরু হয়েছে এ ভোট গ্রহণ। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় যাওয়ার আশা করছেন।

কথিত এক ঘুষ কেলেঙ্কারিকে ঘিরে এখন কেজরিওয়াল ও তাঁর দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। এতে নির্বাচনে দলটির ভালো ফলাফলের সম্ভাবনায় অনিশ্চয়তার ছায়া পড়েছে।

বিশ্বের জনবহুলতম দেশ ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ৫৪৩ জন সংসদ সদস্য বাছাই করবেন ভোটাররা। ছয় সপ্তাহ ধরে চলা সাত দফার এ ভোট গ্রহণ শেষ হবে আগামী ১ জুন। ফলাফল জানা যাবে ৪ জুন।

গুরুত্বপূর্ণ যেসব দল ও প্রার্থীর ভাগ্য এ নির্বাচনে নির্ধারিত হতে চলেছে, জানা যাক তাঁদের সম্পর্কে:

নির্বাচন সামনে রেখে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জনমত জরিপে নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও এর মিত্রদলগুলোর ভালো ফলাফল করার আভাস পাওয়া গেছে। কংগ্রেসসহ ২৪টির বেশি বিরোধী দলীয় ‘ইন্ডিয়া’ জোটের (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) তুলনায় তাদের অবস্থান শক্তিশালী। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত কয়েক দশক রাজনীতি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল কংগ্রেস।

নির্বাচনে ভাগ্য নির্ধারিত হবে ছয়টি পরিচিত জাতীয় দলের কয়েক হাজার প্রার্থীর। দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বিজেপি, কংগ্রেস, দিল্লির শাসক দল আম আদমি পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সবাদী)। এ ছাড়া আছে রাজ্যপর্যায়ে সুপরিচিত ৫৮টির মতো দল। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন অনেক ছোট দলের প্রার্থীরাও।

বিজেপি, নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ

বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিজেপির সদস্যসংখ্যা ১৮ কোটির কাছাকাছি। ১৯৮০ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটি গঠিত হওয়ার পর প্রথম দিকে রাজনীতিতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয় তাদের। ১৬ বছর পর মাত্র ১৩ দিন স্থায়ী একটি অস্থিতিশীল সরকারে দলটি থেকে প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী হন।

বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির অধীন প্রথম সরকার গঠন করে ২০১৪ সালে। এরপর থেকে বেশ শক্তপোক্তভাবেই ক্ষমতায় টিকে আছে দলটি।

এদিকে নরেন্দ্র মোদির (৭৩) জন্ম ও বেড়ে ওঠা ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের ছোট একটি শহরে। বয়স যখন বিশের কোঠায় তখন বিজেপির আদর্শিক অভিভাবক আরএসএসে (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) যোগ দেন তিনি। প্রায় দেড় দশক পর জাতীয়তাবাদী দল জন সংঘে যোগ দেন।

২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার আগে মোদি তিন দফার বেশি সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এক দশক ক্ষমতায় থাকার পর তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রিত্বের লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি। তবে এখনো জনপ্রিয়তা অটুট রয়েছে তাঁর। বিভিন্ন জনমত জরিপের ফলাফল বলছে, এবারও মোদি ও তাঁর দল সহজ জয় পাবে। জনবহুল উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য উত্তর প্রদেশের বারানসি থেকে পুনরায় নির্বাচিত হতে চান মোদি।

অমিত শাহ প্রধানমন্ত্রী মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী। জাতীয় নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন অমিত শাহ। মোদি ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালে বিজেপির সভাপতি পদে আসীন হন অমিত। মোদির দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় ২০১৯ সালে মন্ত্রিসভায় স্থান পান তিনি।

মোদির হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাগুলো সফলভাবে এগিয়ে নিতে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিয়ে আসছেন অমিত শাহ। যেমন মুসলিম জনসংখ্যা–অধ্যুষিত রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়া, বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করা ইত্যাদি। সমালোচকেরা বলছেন, এ আইনে বৈষম্যের শিকার হবেন দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম জনগণ।

গুজরাটের গান্ধীনগর আসন থেকে পুনর্নির্বাচিত হতে চান অমিত শাহ।

আরও পড়ুন

কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধী

ভারতের সবচেয়ে পুরোনো দল কংগ্রেস। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর দুই–তৃতীয়াংশের বেশি সময় ধরে দেশটি শাসন করেছে তারা। তবে দুই দশক ধরে মোদির শাসনামলে রাজনীতিতে রীতিমতো টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছে দলটি।

কংগ্রেস তার প্রথম ও একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পায় ইন্দিরা গান্ধীকে। দলটি ১৯৯১ সালে দেশে সমন্বিত অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়। এতে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দেশটির যাত্রাপথ শুরু হয়। কিন্তু মোদি–ঢেউয়ে ও একগুচ্ছ দুর্নীতি কেলেঙ্কারির জেরে ২০১৪ সালে ক্ষমতা হারায় কংগ্রেস।

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী মোদির সর্বাধিক ঘোরবিরোধী। দলটির তারকা প্রচারক রাহুল। তিনি কখনো কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের মন্ত্রী হননি। সাধারণ নির্বাচনে দলের জয়েও কখনো নেতৃত্ব দেননি। ২০১৯ সালে সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে কংগ্রেসের শোচনীয় হারের পর দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।

তবে এখনো ভারতের বিরোধীদলীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন রাহুল। প্রধানমন্ত্রী মোদিরও প্রধান লক্ষ্য তিনি। তাঁর বাবাসহ পারিবারিক অঙ্গনের পূর্বসূরিরা ৩৭ বছরের বেশি দেশ শাসন করেছেন।

রাহুল (৫৩) চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ২৬ সদস্যের বিরোধীদলীয় জোট ধরে রাখতে ও জোটের প্রতি জনসমর্থন তৈরিতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে ও বিভিন্ন ইস্যুতে দেশজুড়ে দুটি বড় পদযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছেন কংগ্রেসের এই কান্ডারি।

এবারের নির্বাচনে রাহুল দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার ওয়ানাড আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নেহরু–গান্ধী পরিবারের বর্তমান মাতৃপ্রধান সোনিয়া গান্ধী এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

আরও পড়ুন

আম আদমি পার্টি ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল

ভারতের রাজনীতিতে আম আদমি (এএপি) বা কমন পারসনস পার্টির উদ্ভব ২০১১ সালে দুর্নীতিবিরোধী এক শক্তিশালী আন্দোলন থেকে। ঘনিষ্ঠ সহযোগী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সমর্থনে ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন আন্না হাজারে।

পরে ২০১২ সালে এএপি গঠন করেন কেজরিওয়াল। ২০১৫ সালে রাজধানী দিল্লিতে স্থানীয় সরকার গঠন করে তাঁর দল। এতে রাজনীতিতে এক নজিরবিহীন ধাক্কার শিকার হয় বিজেপি ও কংগ্রেসের মতো বড় দলগুলো। তখন থেকেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল মোদির কট্টর সমালোচক হয়ে উঠেছেন। চলতি সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের মিত্র হিসেবে রয়েছে এএপি।

কথিত এক ঘুষ কেলেঙ্কারিকে ঘিরে এখন কেজরিওয়াল ও তাঁর দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। এতে নির্বাচনে দলটির ভালো ফলাফলের সম্ভাবনায় অনিশ্চয়তার ছায়া পড়েছে।

আরও পড়ুন

দ্রাবিড় মুনেত্র কাজগম (ডিএমকে)

দক্ষিণ ভারতের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি দ্রাবিড় মুনেত্র কাজগম (ডিএমকে)। সংসদের নিম্নকক্ষে আসন সংখ্যার দিক থেকে দেশটির তৃতীয় বড় দল এটি। কংগ্রেসের মিত্র এ দলটি তামিলনাড়ু রাজ্যে ক্ষমতাসীন। রাজ্যটিতে দারিদ্র্যের হার মাত্র ২ শতাংশ; যা গোটা ভারতে সর্বনিম্ন দারিদ্র্য হারগুলোর অন্যতম। রাজ্যে শিক্ষার হারও অনেক বেশি।

আরও পড়ুন

অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

সংসদে আসন সংখ্যার দিক থেকে ভারতের চতুর্থ বড় দল তৃণমূল কংগ্রেস। পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে দলটি ক্ষমতায়। প্রায় ২৫ বছর আগে কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গঠিত হয় দলটি।

তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা মমতা ১৩ বছরের কাছাকাছি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন। এ বছরের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপিবিরোধী লড়াইয়ে এক ‘অনিচ্ছুক কংগ্রেস মিত্রের’ ভূমিকায় দলটি। ২৬ সদস্যের বিরোধীদলীয় জোটের শরিক তারা। তবে পশ্চিমবঙ্গের কোন আসনে কোন প্রার্থী লড়বেন, তা নিয়ে এখনো কোনো সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হয়েছে তৃণমূল।

নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থীদের একজন মহুয়া মৈত্র। প্রধানমন্ত্রী মোদির একজন বিরামহীন সমালোচক তিনি। সাবেক ব্যাংকার মহুয়াকে ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গত বছর সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তৃণমূলের এ নেত্রী ঘুষ নেওয়ার ওই অভিযোগকে অতিরঞ্জিত বলে দাবি করেছেন।

আরও পড়ুন