‘থ্রি ইডিয়টসের র্যাঞ্চো’ কীভাবে উদ্ভাবক থেকে দিল্লির চোখে উসকানিদাতা হয়ে উঠলেন
সারা বিশ্ব তিন দশকের বেশি সময় ধরে সোনম ওয়াংচুককে একজন শিক্ষা সংস্কারক, জলবায়ুকর্মী ও উদ্ভাবক হিসেবে চেনেন। তাঁর উদ্ভাবিত বরফের স্তূপা লাদাখের ঠান্ডা মরুভূমিকে নতুন জীবনের আশা দেখিয়েছে। লাদাখ থেকে নয়াদিল্লি; ভারতজুড়ে সবার প্রিয় পাত্র ছিলেন ওয়াংচুক।
কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় ওয়াংচুকের আন্দোলন ধীরে ধীরে তাঁকে লাদাখের জটিল রাজনীতির ভেতর ঠেলে দেয়।
কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় সোনম ওয়াংচুকের আন্দোলন ধীরে ধীরে তাঁকে লাদাখের জটিল রাজনীতির ভেতর ঠেলে দেয়।
লাদাখের ভঙ্গুর পরিবেশ রক্ষার দাবিতে আন্দোলন শুরু করা ওয়াংচুক এই তিন দশকে একজন অনমনীয় রাজনৈতিক কর্মী হয়ে উঠেছেন। তিনি লাদাখের জন্য আলাদা রাজ্যের মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন করছেন এবং ভূমি, কর্মসংস্থান ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সুরক্ষা দাবি করেছেন। এসব আন্দোলন করতে গিয়ে শেষমেশ গতকাল শুক্রবার তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। তাঁকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা আইনে (এনএসএ) গ্রেপ্তার করেছে কেন্দ্রীয় নরেন্দ্র মোদি সরকার।
১৯৬৬ সালে লেহের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম হয় সোনম ওয়াংচুকের। তাঁর জীবনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল বলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়টস’। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া ওই সিনেমায় আমির খান অভিনীত ‘র্যাঞ্চো’ চরিত্রটি তৈরি হয়েছিল সোনম ওয়াংচুকের আদলে।
ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী। লাদাখের বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লাদাখবাসী ধন্যবাদ জানাচ্ছে।...সোনম ওয়াংচুক
সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর লাদাখে ওয়াংচুকের তৈরি স্কুলটি পর্যটকদের কাছে দর্শনীয় স্থান হয়ে ওঠে। সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকা ৫৯ বছর বয়সী এ মানুষটি ২০১৯ সাল থেকে লাদাখের ভঙ্গুর পরিবেশ রক্ষায় আন্দোলন করে যাচ্ছেন।
শৈশবে ওয়াংচুকের শিক্ষা গ্রহণের অভিজ্ঞতাই পরবর্তী জীবনে এ নিয়ে তাঁর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। একজন যান্ত্রিক প্রকৌশলী থেকে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন একজন শিক্ষা সংস্কারক হিসেবে। তিনি লাদাখে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম বিকল্প বিদ্যালয়, যেটির নাম ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ’ (এসইসিএমওএল)।
১৯৯৪ সালে ওয়াংচুক ভারত সরকারের ‘অপারেশন নিউ হোপ’ চালু করতে সহায়তা করেন। এটি ছিল সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার আনার একটি যৌথ উদ্যোগ। এই আন্দোলন তাঁকে লাদাখ এবং জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসনের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল।
ওয়াংচুককে একাধিক শিক্ষা প্রকল্পের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ২০০৫ সালে তিনি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষাবিষয়ক জাতীয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য মনোনীত হন।
১৯৯৪ সালে তিনি ভারত সরকারের ‘অপারেশন নিউ হোপ’ চালু করতে সহায়তা করেন। এটি ছিল সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার আনার একটি যৌথ উদ্যোগ। এই আন্দোলন তাঁকে লাদাখ এবং জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসনের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল।
ওয়াংচুক লাদাখের ভঙ্গুর পরিবেশের নানা সংকটের বাস্তব সমাধান খোঁজার দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি ২০১৩ সালে বরফের স্তূপা উদ্ভাবন করেন। এটি কৃত্রিম হিমবাহ, যা পানি সংরক্ষণ করে রাখতে সাহায্য করে। এটি লাদাখের গ্রীষ্মকালে তীব্র পানিসংকটের খুবই কার্যকর ও সহজলভ্য সমাধান হয়ে আসে, বিশেষ করে সেখানকার কৃষকদের জন্য।
লাদাখের পরিবেশের প্রতি গভীর আগ্রহ ওয়াংচুককে একজন পরিবেশকর্মীতে রূপান্তর করে। তাঁর এসইসিএমওএল প্রথম কোনো সবুজ ক্যাম্পাস, যেটি সম্পূর্ণরূপে সৌরবিদ্যুতে পরিচালিত। এ কাজের জন্য তিনি ২০১৮ সালে ম্যাগসেসে পুরস্কার পান।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট যখন ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে এবং রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখে ভাগ করে, লেহের অধিকাংশ মানুষের মতো ওয়াংচুক এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে (বর্তমান নাম এক্স) এক পোস্টে ওয়াংচুক লিখেছিলেন, ‘ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী। লাদাখের বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লাদাখবাসী ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। ঠিক ৩০ বছর আগে, ১৯৮৯ সালের আগস্টে লাদাখের নেতারা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এই গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণে যাঁরা সাহায্য করেছেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ।’
২০২০ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে গালওয়ানে সংঘর্ষের সময় ওয়াংচুক লাদাখের বাসিন্দাদের তাদের ‘পকেটের জোর’ দেখাতে এবং চীনা পণ্য বর্জন করতে বলেছিলেন। তার এক বছর পরে তিনি বৈরী পরিবেশে অবস্থান করা ভারতীয় সৈন্যদের জন্য সৌরশক্তি দ্বারা পরিচালিত তাঁবু তৈরি করেন।
তত দিন পর্যন্ত ওয়াংচুক সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। ২০২৩ সালে বিশ্বের অন্যতম উঁচু পর্বতমালা খারদুং লার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লাদাখের ভঙ্গুর জীববৈচিত্র্যে যে প্রভাব পড়ছে, তা তুলে ধরতে এবং লাদাখের বাসিন্দাদের ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের (সিক্সথ শিডিউল) অধীনে সুরক্ষা দেওয়ার দাবিতে অনশন শুরু করেন।
ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের নির্ধারিত উপজাতিদের জন্য বিশেষ অধিকার সংরক্ষণ করা আছে। ভারত সরকার ওয়াংচুককে ওই অনশন চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি এবং তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখে।
সে সময় এক রাজনৈতিক বক্তৃতায় ওয়াংচুক বলেছিলেন, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার চেয়ে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সঙ্গে থাকার সময়ই লাদাখ ভালো ছিল।
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার চেয়ে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সঙ্গে থাকার সময়ই লাদাখ ভালো ছিল...সোনম ওয়াংচুক
২০২৪ সালে ওয়াংচুক লাদাখের জন্য সংবিধানিক সুরক্ষার দাবিতে আমৃত্যু অনশনের ঘোষণা দেন। সঙ্গে তিনি এবার লাদাখকে খনিশিল্পের দালালদের প্রভাবমুক্ত রাখার দাবি জানান। এটি তাঁকে সরাসরি কেন্দ্রীয় মোদি সরকারের মুখোমুখি করে দেয়।
মোদি সরকার ওয়াংচুকের ওপর চাপ বৃদ্ধি করতে শুরু করে। প্রথমে তাঁর হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অব অলটারনেটিভস, লাদাখের জমি বরাদ্দ বাতিল করে। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত শুরু করে। কিন্তু সরকারের চাপে মাথা নোয়াননি বলিউড সিনেমার পর্দার এই ‘র্যাঞ্চো’।
এবার সিনেমা পর্দার ‘র্যাঞ্চো’ মোদি সরকার ও লাদাখের মূল কমিটির মধ্যে আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার দাবিতে অনশন শুরু করেন। আগামী ৬ অক্টোবর ওই বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।
সোনম ওয়াংচুকের অনশনের পঞ্চদশ দিন গত বুধবার একদল তরুণ লাদাখের রাস্তায় নেমে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। তাদের দমনে গুলি চালায় পুলিশ, এতে চার বিক্ষোভকারী নিহত হন।
মোদি সরকার ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে ‘উসকানিমূলক বক্তব্য’ দেওয়ার অভিযোগ তোলে। মোদি সরকারের অভিযোগ, তাঁর উসকানিতে তরুণেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তাঁর প্রতিষ্ঠান এফসিআরএর নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। তিন দিনের বিক্ষোভের পরিসমাপ্তি ঘটে ওয়াংচুকের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে।
আগেই নিজে গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ওয়াংচুক। তিনি বলেছিলেন, তিনি কারাগারে যেতে প্রস্তুত। তবে কারাগারে বন্দী ওয়াংচুক হয়তো বাইরে থাকা সোনম ওয়াংচুকের চেয়ে (কেন্দ্র সরকারের জন্য) বেশি সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারেন।