বিজেপি সরকারের বিরোধিতা করে এবার কি বিপদে বাস্তবের ‘র‌্যাঞ্চো’

ভারতের লাদাখের রাজধানী লেহতে আমরণ অনশনে সোনম ওয়াংচুক। ১৯ মার্চছবি: এএনআই

লাদাখে আন্দোলনরত বিশিষ্ট পরিবেশকর্মী ও শিক্ষাবিদ ম্যাগসাইসাই পুরস্কারজয়ী বাস্তবের ‘র‌্যাঞ্চো’ সোনম ওয়াংচুক বেনামে এক হুঁশিয়ারি চিঠি পেয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, তাঁর প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের সবকিছু কেন্দ্রীয় আর্থিক অনিয়ম তদন্তকারী সংস্থা (ইডি) জোগাড় করেছে। তাই তাঁকে আগে থেকে সাবধানী হতে অনুরোধ করা হয়েছে। আরও লেখা হয়েছে, ঠিক এইভাবে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ব্যাংক হিসাবও নেওয়া হয়েছিল।

সোনম ওয়াংচুক নিজেই গতকাল সোমবার এক ভিডিও বার্তায় ওই চিঠি ও তার সারমর্ম জানিয়ে বলেছেন, কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র পাকানো হচ্ছে। লাদাখের লোকজন ভালোবাসেন বলেই এভাবে তাঁকে সজাগ করে দিয়েছেন।

আমির খানের জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়টস’–এর নায়ক ফুংসুক ওয়াংচুক চরিত্রটি যাঁর আদলে তৈরি, পর্দায় যাঁর নাম ছিল ‘র‌্যাঞ্চো’, তিনিই বাস্তবের সোনম ওয়াংচুক। ৫৭ বছর বয়সী এই প্রকৌশলী ও উদ্ভাবক লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা, পরিবেশ রক্ষাসহ কয়েকটি দাবিতে ‘আমরণ অনশন’ কর্মসূচি পালন করেন। লাদাখের পর্বতরাজি বিভিন্ন শিল্প সংস্থা ও খনির কারবারিদের কাছে বেচে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার এই বিস্তীর্ণ এলাকাকে কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি।

পরবর্তী সময়ে ওয়াংচুক ১০ হাজার লাদাখবাসীর সঙ্গে গলওয়ান এলাকায় মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, ২০২০ সালের জুনে ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর চীন কতটা জমি ছিনিয়ে নিয়েছে, তা দেখা। কেন্দ্রশাসিত লাদাখের প্রশাসন তাঁদের সেই অনুমতি দেয়নি। ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল মিছিল রুখতে।

ওয়াংচুক অবশ্য দমে যাননি। লাদাখবাসীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি অনশন সত্যাগ্রহ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। লাদাখের হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন তাঁর আন্দোলনে সমর্থন জানাচ্ছেন। ঠিক এই সময়েই ওই চিঠি। গতকাল প্রচারিত ওই ভিডিওতে সোনম ওয়াংচুক নিজেই এর উল্লেখ করেন।

ভিডিও বার্তায় ওয়াংচুক বলেন, যে মানুষটি তাঁকে ওই চিঠি দিয়ে চলে গেছেন, তিনি তাঁকে চেনেন না। তাঁর ধারণা, বাইরের অন্য কেউ ওই চিঠিটি তাঁকে দিতে ওই ব্যক্তিকে দিয়েছিলেন। একটি সাদা খামের মধ্যে ওই চিঠিটি ছিল। খামটি ‘স্টেপল’ করা ছিল।

ওয়াংচুক বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম চিঠিটির কথা জানাব না। কিন্তু তারপর ভেবে দেখলাম, সবাইকে জানানোই ভালো। চিঠিতে লেখা, “স্যার, এই চিঠি লেখার উদ্দেশ্য একটাই। আপনাকে সতর্ক ও সজাগ করে দেওয়া। আপনার সংস্থার ব্যাংক হিসাব সম্প্রতি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অ্যান্টি মানি লন্ডারিং বিভাগ নিয়ে গেছে। কেজরিওয়ালের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই হয়েছিল। এ কথা আপনাকে জানানোর কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু ভেবে দেখলাম জানানো উচিত। খুব বেশি দেরি হওয়ার আগে আপনি যাতে সজাগ ও সতর্ক হতে পারেন।”’

আরও পড়ুন

ভিডিওতে চিঠি পড়ার পর ওয়াংচুক বলেন, ‘এর মানে আমার পেছনে কিছু একটা চলছে। কোনো এক ষড়যন্ত্র। যিনি এটা দিয়েছেন, তিনি অচেনা। মনে হচ্ছে এই চিঠি হয় ব্যাংকের কেউ নতুবা কোনো তদন্তকারী সংস্থার কারও পাঠানো।’ তিনি বলেন, ‘এই সময় হাজারো লাদাখবাসী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়েছেন, ফলে সরকারের কোনো অঙ্গ, সে পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থা হোক না কেন, তাদের কোনো পদক্ষেপের কথা তাদের কর্মীরাই আমাদের আগাম জানিয়ে দেন ভালোবেসে। আমাদের আন্দোলনের স্বার্থে, সমর্থন জানিয়ে।’

সোনম ওয়াংচুক ভিডিওটি শেষ করেছেন ওই তদন্তকে স্বাগত জানিয়ে। কারণ, তিনি মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে সত্য প্রকাশিত হবে। ভিডিওর শেষে জানানো হয়েছে, সোনম ও তাঁর স্ত্রী গীতাঞ্জলি তাঁদের সংস্থা থেকে কোনো বেতন নেন না। প্রতিবছর তাঁরা প্রায় দুই কোটি রুপি দান করেন। লাদাখে আয়কর দিতে হয় না, কিন্তু তবুও তাঁরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আয়কর দেন। পৃথিবীর কোথাও তাঁদের নামে কোনো সম্পত্তি নেই।

জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পাঁচ বছর পরও সেই প্রতিশ্রুতি পালিত হয়নি। মাসকয়েক আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লাদাখের নির্বাচিত প্রতিনিধিদলকে জানিয়ে দেন, তা করা হবে না। সেই থেকে লাদাখবাসীদের মনে কেন্দ্রবিরোধী ক্ষোভ জন্মেছে।

আরও পড়ুন

লাদাখের বিজেপি সংসদ সদস্য জামিয়াং শেরিং নামগিয়াল চীনের জমি দখলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী লেহ ও মুসলমান–অধ্যুষিত কারগিল। দুই সম্প্রদায়ের লোকজনই এখন পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদার দাবিতে আন্দোলনে শামিল। খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ লাদাখের জমি বৃহৎ শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে তাঁরা সবাই ওয়াংচুকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের শরিক।

এই পরিস্থিতিতে বিজেপি লোকসভা ভোটে নামগিয়ালকে টিকিট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। টিকিট দিয়েছে তাশি গিয়ালসনকে, যিনি বিজেপি-পিডিপি জোট ভেঙে যাওয়ার পর পিডিপি ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন নামগিয়াল। লাদাখের ভোট আগামী ২০ মে। ২০১৪ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি লাদাখ আসনটি জিতেছিল।

বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজনৈতিকভাবে যেখানে তারা বিরোধিতার মুখে পড়ে, সেখানেই তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে ইডি, সিবিআই, আয়কর বিভাগ, এনআইএকে লাগিয়ে দেয়। বিরোধীদের কাছে এই অভিযোগ ক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠছে।