কী অবস্থান নেবেন আসামের নতুন মুখ্যমন্ত্রী

আসামের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মা (ছবিতে বাঁয়ে)
ছবি: এএফপি

বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে সাত দিন টানাপোড়েন চলল আসামের নতুন মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়ে। রোববার ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হলো বিদায়ী সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বসছেন আসামের চালকের আসনে। তিনি শপথ নেবেন সোমবার।

মুখ্যমন্ত্রীর পদ নিয়ে হিমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলছিল বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়ালের। নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে আলোচিত ভারতের এই রাজ্যে আগের বারও ক্ষমতায় ছিল বিজেপি।

আসামের মূল নিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং ওই রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী আদর্শকে গড়ে তুলতে সর্বানন্দের বড় ভূমিকা রয়েছে। ছাত্র অবস্থায় আসামের আঞ্চলিক দল অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের  নেতা সর্বানন্দ বরাবরই বিজেপির সঙ্গে ছিলেন। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ চেয়েছিল, তিনি আবার আসামের মুখ্যমন্ত্রী হোন।

অপরদিকে হিমন্ত বিশ্বশর্মা দীর্ঘদিন বিজেপির বিরোধী শিবির কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন। দলটির কর্মী থেকে নেতা ও এমএলএ হয়েছিলেন তিনি। ২০০১, ২০০৬ ও ২০১১ পরপর তিনবার তিনি কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে আসাম বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছেন এবং মন্ত্রী হিসেবে নানা দপ্তর সামলেছেন। তাঁর দ্রুত উত্থান কংগ্রেসের ভেতরে হিমন্তকে মুখ্যমন্ত্রীর দাবিদার করে তোলে, তাঁর সঙ্গে সমস্যা শুরু হয় সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত তরুণ গগৈয়ের।

পরে দুজনেই কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারস্থ হন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর বিরোধিতার কারণে হিমন্ত বিশ্বশর্মা ২০১১ সালের নির্বাচনে তৃতীয়বার জেতার পরও মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি। পরে ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

অচিরেই হিমন্ত শুধু আসাম নয়, গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতে বিজেপির প্রধান মুখ ও ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’–এ পরিণত হন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের প্রায় সব কটিতে বিজেপি ও তার শরিক দলগুলোকে ক্ষমতায় আনার পাশাপাশি হিমন্ত বিজেপির হয়ে একটি বড় সংকট সামাল দেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সংসদে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাস হওয়ার পরে আসামে বড় ধরনের আন্দোলন শুরু হয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়া আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা সব ধর্মের মানুষকে স্বাভাবিকভাবে নাগরিক করার কথা বলা হলেও মুসলমানদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে এ আইনে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

আসামের বিক্ষুব্ধদের বক্তব্য ছিল, এ আইন বাস্তবায়িত হলে বাইরের মানুষ আসামে বসবাস করতে পারবে। তা আসামের মতো ছোট রাজ্যের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।

বিজেপি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পশ্চিমবঙ্গে বাস্তবায়িত করবে বলে তাদের ইশতেহারে জানালেও আসামে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

এ আন্দোলন যখন বিজেপির হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তখন হিমন্ত বিশ্বশর্মা নানা কৌশল অবলম্বন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তাতে খুশি হয় বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বিজেপি বা হিমন্ত কেউ আর আইনটি নিয়ে কথা বলেনি।

এদিকে নাগরিক শনাক্তকরণের পঞ্জি, ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন (এনআরসি) নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে বিজেপি ও হিমন্ত বিশ্বশর্মা। এনআরসির মাধ্যমে ২০১৯ সালে আসামে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, বলা হয়েছিল নাগরিকপঞ্জিতে তাঁদের নাম নেই। এঁদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু, ফলে বিজেপি বেশ খানিকটা বিপদে পড়ে গিয়েছিল। হিমন্ত বলেছিলেন, ‘এনআরসি প্রক্রিয়া ভুল ছিল। ক্ষমতায় এলে নতুন এনআরসি করা হবে।’

গত বছর নভেম্বরে তিনি বলেছিলেন, আসামের প্রধান সমস্যা ‘আধুনিক মোগলদের’ নিয়ে অর্থাৎ মুসলমানদের প্রবেশ ও বসবাস। ক্ষমতায় এলে আধুনিক মোগলদের চিহ্নিত করা হবে এনআরসির মাধ্যমে।

নির্বাচনী ইশতেহারেও বিজেপি বলেছে, তারা সংশোধিত এনআরসি বাস্তবায়িত করবে। নির্বাচনী প্রচারে হিমন্ত গত ফেব্রুয়ারি মাসে খোলাখুলি বলেছিলেন, ‘মিয়া-মুসলিমদের চাই না। ওঁরা সাম্প্রদায়িক। ওঁরা আসামের সংস্কৃত ভাষাকে নষ্ট করছে। ওদের ভোটে আমি এমএলএ হতে চাই না।’

অর্থাৎ আসামে নির্বাচনে জেতার জন্য একটা খুব স্পষ্ট হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে বিভাজনের নীতি হিমন্ত বিশ্বশর্মা ও বিজেপি নিয়েছিল, সেটা কাজেও দিয়েছে। ফলে নতুন এনআরসি তাদের করতে হবে। এর মাধ্যমে যাঁদের চিহ্নিত করা হবে, তাঁদের নিয়ে আসাম ও ভারত সরকার কী করবে, সেটা একটা প্রশ্ন।

২০০৯ সালের পরে আসাম ছয়টি বন্দিশালা (ডিটেনশন সেন্টার) বানিয়েছে। সেগুলোতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে রাখা হয়েছে। তবে আসাম সরকার দাবি করেছে, আদালতের নির্দেশে এরই মধ্যে তারা অধিকাংশ বন্দী ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু সংশোধিত এনআরসি আসার পরে নতুন করে চিহ্নিতদের কী হয়, হিমন্ত বিশ্বশর্মার নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার আসার পরে সেদিকে নজর থাকবে অনেকের।