বুলডোজার নামল দিল্লিতেও

দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরীতে সংখ্যালঘুদের দোকান–পাট উচ্ছেদ অভিযান।
ছবি: রয়টার্স

ভারতের উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটের পর বুলডোজার নামল দেশটির রাজধানী দিল্লিতেও। দাঙ্গাকবলিত জাহাঙ্গীরপুরীর মুসলিম–অধ্যুষিত এলাকায় ‘অবৈধ স্থাপনা’ হঠাতে বুধবার সকাল থেকেই কাজে নামানো হয় একাধিক বুলডোজার।

স্থানীয় মসজিদ এলাকায় যাবতীয় ‘অবৈধ স্থাপনা’ ভাঙা শুরু হয় সকাল নয়টায়। সকাল ১০টায় একাধিক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। প্রধান বিচারপতি এন ভি রমনা ভাঙচুর স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও অভিযান অব্যাহত থাকে। দুই ঘণ্টা পর বেলা একটা নাগাদ অভিযান বন্ধ হয়। ততক্ষণে ওই এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বহু দোকান ও ঘর বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে ফেলা হয়। এ নিয়ে উত্তেজনা যতটা, ততটাই সরগরম রাজনীতি।

দাঙ্গাকবলিত এলাকায় বুলডোজার চালিয়ে প্রধানত সংখ্যালঘুদের ‘শাস্তি’ দিতে যে উপায় শাসক বিজেপি গ্রহণ করেছে, সে বিষয়ের মামলার শুনানি সুপ্রিম কোর্টে বৃহস্পতিবার শুরু হবে। ওই মামলা করেছে জামায়াত ই উলেমা হিন্দ।

বিজেপি–শাসিত উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সমাজবিরোধী দমনে প্রথম বুলডোজার ব্যবহার করেন। উদ্দেশ্য মূলত রাজ্যের মুসলমান বাহুবলীদের শিক্ষা দেওয়া। দাঙ্গাকবলিত এলাকায়ও ব্যবহৃত হয় বুলডোজার। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের কাছে এই নীতি বিশেষ জনপ্রিয় হয়। মুখ্যমন্ত্রীর নামকরণ হয় ‘বুলডোজার বাবা’। সম্প্রতি রামনবমীতে দাঙ্গার পর মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানও বুলডোজার ব্যবহার করেন।

ব্রিটিশ আমলের ‘পিটুনি কর’–এর ধাঁচে চালু করেন ‘দাঙ্গা কর’। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীও বুলডোজার নীতি আঁকড়ে ধরার কথা বলেছেন। এরপরই দিল্লির দাঙ্গাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে কোমর কষে নামেন দিল্লির বিজেপি নেতারা।

দিল্লি বিজেপির সভাপতি আদেশ গুপ্ত উত্তর দিল্লি পৌরসভাকে গত মঙ্গলবার চিঠি লিখে জাহাঙ্গীরপুরী এলাকায় বুলডোজার ব্যবহার করতে বলেন। আজ সকালেই দেখা যায়, নয়টি ‘আর্থ মুভার’ ওই এলাকায় পৌঁছে গেছে। সঙ্গে বিশাল পুলিশ বাহিনী। নয়টায় ভাঙা শুরু হয় ‘অবৈধ স্থাপনা’। একই সময়ে সুপ্রিম কোর্টে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান আইনজীবী কপিল সিব্বাল, দুষ্মন্ত দাভেসহ বহু আইনজীবী। তাঁদের অভিযোগ, কোনো নোটিশ না দিয়ে অসাংবিধানিকভাবে পৌরসভা অভিযান চালাচ্ছে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে আগেই আবেদন জানানো হয়েছে। প্রধান বিচারপতি রমনা অভিযান স্থগিতাদেশের নির্দেশ দিলেও তা অব্যাহত থাকে।

পৌর কর্তৃপক্ষের দাবি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কপি তাদের কাছে পৌঁছায়নি। সিপিএম নেতা বৃন্দা কারাত ও হান্নান মোল্লা আদালতের নির্দেশের কপি নিয়ে বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। প্রধান বিচারপতির নির্দেশ পুলিশ কমিশনারকে জানানো হলে বেলা একটা নাগাদ অভিযান বন্ধ হয়। ততক্ষণে অগুনতি ‘অবৈধ স্থাপনা’ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। জীবিকা হারায় শতাধিক পরিবার।

রাজধানী-রাজ্য দিল্লিতে ক্ষমতায় আম আদমি পার্টি (আপ)। কিন্তু তিন পৌরসভায় বিজেপি ক্ষমতাসীন। দিল্লির পুলিশও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। অভিযান উপলক্ষে ৪০০ পুলিশ সদস্য ও দাঙ্গারোধী বাহিনী মোতায়েন করা হয়। এটা স্পষ্ট যে অভিযানের উদ্দেশ্য প্রধানত দাঙ্গাকারী মুসলমানদের ‘উচিত শিক্ষাদান’। যদিও উত্তর দিল্লি পৌরসভার মেয়র বিজেপি নেতা রাজা ইকবাল সিং বলেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের এ অভিযান অনেক দিনের। জবরদখলের দরুন স্থানীয় মানুষের অবস্থা করুণ। রাস্তায় যানজট নিত্যদিনের ভোগান্তি। এর সঙ্গে দাঙ্গার কোনো সম্পর্ক নেই।

তিনি জানান, বুধ ও বৃহস্পতিবার—দুই দিন ধরে এ অভিযান চালানোর কথা। স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, স্থাপনা ভাঙার কোনো নোটিশ পৌরসভা কাউকে দেয়নি। কাউকে সতর্কও করা হয়নি। বেআইনি স্থাপনা দিল্লিতে অগুনতি। কিন্তু এভাবে উচ্ছেদ অভিযান দেখা গেল শুধু জাহাঙ্গীরপুরীর মুসলিম–অধ্যুষিত অঞ্চলে। বুলডোজার বা আর্থ মুভারের এমন ব্যবহারও এই প্রথম। দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদিয়া গতকাল বলেন, ১৫ বছর ধরে বিজেপির যেসব নেতা অবৈধ স্থাপনার জন্য ঘুষ নিয়েছেন, তাঁদের বাড়ি বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হোক।

জাহাঙ্গীরপুরীর দাঙ্গার পর মোট ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অধিকাংশই মুসলমান। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। এ আইনে বিনা বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এক বছর পর্যন্ত আটক রাখা যায়।