লিওনেল মেসিকে সোনার ঝালরবিশিষ্ট একটি বিশেষ গাউন পরিয়ে দেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি
ছবি: রয়টার্স

কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে শতকোটি মানুষের চোখ ছিল দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামে। ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার শ্বাসরুদ্ধকর এক জয় দেখেছেন সবাই। তবে এই খেলা এবং খেলা শেষে উদ্‌যাপন বাদেও একটা বিষয় অনেকের নজর কেড়েছে। তা হলো বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে তুলে দেওয়ার আগে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসিকে আরবের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘বিশত’ পরানোর বিষয়টি। এ নিয়ে পশ্চিমা অনেক গণমাধ্যমের বর্ণবাদী আচরণও অনেকের নজরে এসেছে।

১৯৭০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে শিরোপাজয়ী পেলেকে মেক্সিকোর বিশেষ ধরনের টুপি ‘সোমব্রেরো’ পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন কিন্তু কেউ বলেনি পেলের উদ্‌যাপনের মুহূর্ত ‘অপহরণ’ করা হয়েছিল, ঠিক যে শব্দটা মেসিকে বিশত পরানো নিয়ে ব্যবহার করেছে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম সেভেন নিউজ।

মেসিকে বিশত পরানো নিয়ে পশ্চিমা অনেক পণ্ডিত ও সাংবাদিক যে বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশ করেছেন, তা অবশ্য নতুন নয়। কাতার বিশ্বকাপের পুরো সময়টা, এমনকি এর আগের এক বছর ধরে একই ধরনের বর্ণবাদী মনোভাব দেখিয়ে আসছেন তাঁরা। তাঁদের কথাবার্তায় এটা ভালোমতোই বোঝা যায় যে পশ্চিমা বার্তাকক্ষগুলোয় বৈচিত্র্যের ঘাটতি আছে। আর নিজেদের চেনা জগতের বাইরের রীতিনীতিগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতাও তাঁদের কম।

শিরোপা জয়ের পর মেসিকে বিশত পরানো নিয়ে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের শিরোনাম ছিল এমন, ‘বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মুহূর্তটিকে মাটিতে মিশিয়ে দিল এই উদ্ভট কাজটি’। পরে অবশ্য শিরোনামটি সংশোধন করা হয়েছিল। আর যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ফক্স স্পোর্টসের শিরোনাম ছিল, ‘অত্যন্ত ভয়ানক’। ইয়াহু স্পোর্টস শিরোনামে ব্যবহার করেছে ‘অসম্মানজনক’ শব্দটি।

অনেকে আবার নিজের মতো করে বর্ণবাদী মন্তব্য করেছেন। যেমন খেলাধুলাবিষয়ক টেলিভিশন চ্যানেল ইএসপিএনের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মার্ক ওগডেন। তিনি লিখেছেন, ‘একজন তাঁকে (মেসি) হাতাকাটা জোব্বা পরিয়ে দিচ্ছেন, এটা সব ছবিকে নষ্ট করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, তিনি যেন একটু পরে চুল কাটবেন।’ একইভাবে ফুটবলবিষয়ক একটি টেলিভিশন চ্যানেলের উপস্থাপক ড্যান ওয়াকার টুইট করেন, ‘আমি বাজি ধরতে পারি, এমবাপ্পে সোনার কাজ করা এই অদ্ভুত জোব্বা না পরতে পেরে খুশিই হয়েছেন।’ পরে তিনি টুইটটি মুছে ফেলেন।

মায়ের সঙ্গে মরক্কোর মিডফিল্ডার সোফিয়ান বুফালের উদ্‌যাপন
ছবি: টুইটার নেওয়া

বিশত নামের পোশাকটি আরবের অন্য দেশগুলোতে আবা বা আবায়া নামেও পরিচিত। এটি মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক। সাধারণত বিশেষ উৎসবে বিশত পরা হয়। পোশাকটি পরে থাকেন ধর্মীয় নেতা, রাজনীতিক ও আরবের বিভিন্ন গোত্রের প্রধানেরা। অনেক সময় বড় কোনো সফলতা উদ্‌যাপনেও বিশত পরা হয়। আর কাতারের আমিরের মতো বিশেষ কেউ যদি পোশাকটি পরিয়ে দেন, সেটা তো বিরল সম্মানের বিষয়। এটা অনেকটা ব্রিটেনের নাইট খেতাব দেওয়া বা রাজার অভিষেক হওয়ার মতো। বিশত পরিয়ে মেসিকে এমন সম্মানই জানানো হয়েছে।

এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা শুধু শিরোপাই জেতেনি। অনেকের চোখে মেসি সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁদের কাছে মেসি এখন ব্রাজিলের কিংবদন্তি পেলে এবং আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। এখন তাঁর দখলে রয়েছে ফুটবলের সব বড় শিরোপা। এমনকি সাতবার ব্যালন ডি’অর জিতেছেন তিনি। বছরের সেরা ফুটবলারকে ব্যালন ডি’অর পুরস্কার দেওয়া হয়।

জয়ের পর মরক্কোর খেলোয়াড়েরা তাঁদের মায়েদের সঙ্গে উদ্‌যাপন করছেন, এমন অনেক ছবি সাড়া ফেলেছে। আরব ও আফ্রিকার মানুষের কাছে পরিবার যে কতটা গুরুত্ব রাখে, তা ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। এটা নিয়েও বাঁকা মন্তব্য করতে ছাড়েনি ডেনমার্কের একটি সংবাদমাধ্যম। মায়ের সঙ্গে সন্তানের এ উদ্‌যাপনকে তারা তুলনা করেছে বানরের পরিবারের সঙ্গে।

আমি জানি যে ছেলেবেলা থেকেই মেসির স্বপ্ন ছিল আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলা। হয়তো তিনি ম্যারাডোনার মতো আর্জেন্টিনার জার্সি পরে বিশ্বকাপের ট্রফিটাও উঁচিয়ে ধরতে চেয়েছিলেন। মঞ্চের ঘটনা মেসির ওই ইচ্ছায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এমন কথা তুললেও তা যৌক্তিক হতো। তবে তারা এর আশপাশ দিয়েও যায়নি। অঞ্চলভেদে উদ্‌যাপন যে ভিন্ন হতে পারে, সেটা আসলে তারা মেনে নিতে পারেনি।

যখন বিশত পরানো হচ্ছিল, তখন মেসি একমুহূর্তের জন্যও পোশাকটিকে তাচ্ছিল্য করেননি। তাঁর আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জার্সিটাও একইভাবে বিশ্বের বড় একটি অংশ আপন করে নিয়েছে। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে সারা বিশ্বের জার্সিটি বিপুল সংখ্যায় বিক্রি হয়েছে। বড় কথা হলো, স্থানীয় সংস্কৃতিকে বহন করে, এমন উপহার বা পোশাক বিজয়ী খেলোয়াড়দের দেওয়ার ঘটনা যে সচরাচর ঘটে না, তা কিন্তু নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৭০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ। সেবার শিরোপাজয়ী পেলেকে মেক্সিকোর বিশেষ ধরনের টুপি ‘সোমব্রেরো’ পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন কিন্তু কেউ বলেনি পেলের উদ্‌যাপনের মুহূর্ত ‘অপহরণ’ করা হয়েছিল, ঠিক যে শব্দ মেসিকে বিশত পরানো নিয়ে ব্যবহার করেছে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম সেভেন নিউজ।

বলতে গেলে, এবারের বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে যেদিন কাতারকে নির্বাচিত করা হলো, সেদিন থেকেই পশ্চিমা অনেক গণমাধ্যম যে বড় ধাক্কা খেয়েছে, তা তাদের ভাবভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল। টুর্নামেন্টের শুরুতেই সংস্কৃতিগত নানা বিষয় নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছে। টুর্নামেন্ট চলার পুরো সময়ও একই বিষয় নিয়ে কথা তোলা হয়েছিল। আর আরব সংস্কৃতি নিয়ে তাদের জ্ঞানের ঘাটতির শেষ প্রকাশটা হলো মেসির বিশত পরা নিয়ে বর্ণবাদী মন্তব্যে।

কাতার বিশ্বকাপে মরক্কোর সফলতা আরব ও আফ্রিকার মানুষের কাছে গর্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন ইরাকি ও আরব হিসেবে আমার কাছে অন্য একটি আরব দেশের জয়োল্লাস দেখা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। তবে বিশতের মতো মরক্কোর একের পর এক জয় নিয়েও পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো আরববিরোধী মনোভাব দেখিয়েছে।

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে মেসি, দি মারিয়া, দিবালাদের বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস
ছবি : ফিফা

আকাশের দিকে আঙুল তুলে মরক্কোর খেলোয়াড়দের উদ্‌যাপনকে জার্মান সংবাদমাধ্যম ভেল্ট তুলনা করেছে সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) যোদ্ধাদের সঙ্গে। গোল করার পর মেসি যখন আকাশের দিকে আঙুল তুলে উদ্‌যাপন করেন, তখন কিন্তু চুপ থাকে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো। জয়ের পর মরক্কোর খেলোয়াড়েরা তাঁদের মায়েদের সঙ্গে উদ্‌যাপন করছেন, এমন অনেক ছবি সাড়া ফেলেছে। আরব ও আফ্রিকার মানুষের কাছে পরিবার যে কতটা গুরুত্ব রাখে, তা ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। এটা নিয়েও বাঁকা মন্তব্য করতে ছাড়েনি ডেনমার্কের একটি সংবাদমাধ্যম। মায়ের সঙ্গে সন্তানের এ উদ্‌যাপনকে তারা তুলনা করেছে বানরের পরিবারের সঙ্গে।

পশ্চিমা গণমাধ্যমের বার্তাকক্ষগুলোতে ভিন্ন মতাদর্শের প্রতিনিধিত্বে ঘাটতি আছে। তাই তাদের সাংবাদিকতায় এ ধরনের বর্ণবাদ, অজ্ঞতা ও অযোগ্যতা প্রকাশ একেবারে অবাক করে দেওয়ার মতো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ মানুষ শ্বেতাঙ্গ নন। তবে ২০২০ সালে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটির শীর্ষস্থানীয় সম্পাদকদের ৯০ শতাংশই শ্বেতাঙ্গ। বার্তাকক্ষে জ্যেষ্ঠ পর্যায়ে বৈচিত্র্যে যদি উন্নতি আনা যায়, তা এ ধরনের মূর্খতা ঠেকাতে সংবাদমাধ্যমগুলোকে সহায়তা করবে।

আরব বিশ্বে অনেকেই আনন্দে মশগুল হয়ে বিশত পরা আর্জেন্টিনার ক্যাপ্টেনকে ‘শেখ মেসি’ বলে ডাকছেন। আরবে মেসি যে কতটা ভালোবাসা পেয়েছেন, তা এই সম্বোধনের মাধ্যমে বোঝা যায়। আসুন আমরা মেসি ও আর্জেন্টিনার গৌরবময় জয়কে বর্ণবাদী প্রতিহিংসার থাবায় কলঙ্কিত হতে না দিই।