প্রেম-ভালোবাসা এত জটিল হচ্ছে কেন

বর্তমান সময়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রেম বা সঙ্গী খুঁজে পাওয়া আগের চেয়ে অনেক জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছেছবি: পেক্সেলস

প্রেমের বড় আকাল। বর্তমান সময়ে প্রেম বা সঙ্গী খুঁজে পাওয়া আগের চেয়ে অনেক জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পেশাদার ম্যাচমেকার ও সার্টিফায়েড লাইফ কোচ পল ক্যারিক ব্রানসন তাঁর ‘ফাইন্ড লাভ: হাউ টু নেভিগেট মডার্ন লাভ অ্যান্ড ডিসকভার দ্য রাইট পার্টনার ফর ইউ’ বইয়ে বর্তমান সময়ে এই প্রেমের আকাল নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে বইটি প্রকাশ করা হয়েছে।

এই প্রেমের আকাল নিয়ে ব্রানসনের সঙ্গে পুরস্কারজয়ী বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ডেভিড রবসন নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন মানুষের সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে কি না, তা জানতে চেয়েছেন রবসন। প্রযুক্তি প্রেমিক-প্রেমিকা অথবা যৌনসঙ্গীদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেক নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এতে মানুষের মনোভাব বদলাচ্ছে কি না জানতে চান রবসন।

জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন

ব্রানসন বলেছেন, সঠিক সঙ্গী খোঁজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত। ‘ফাইন্ড লাভ: হাউ টু নেভিগেট মডার্ন লাভ অ্যান্ড ডিসকভার দ্য রাইট পার্টনার ফর ইউ’ বইয়ে গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তিনি বলেছেন, বর্তমান সময়ে প্রেম-ভালোবাসা ধরে রাখা মানব ইতিহাসের যেকোনো কাজের চেয়ে কঠিন। এর একটি কারণ হলো, বর্তমানে গ্রহণযোগ্য সম্পর্ক হিসেবে বিবেচিত হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে। কেউ একগামী বা বহুবিবাহ সম্পর্কের মধ্যে থাকতে পারেন, কেউ আবার সঙ্গীর সঙ্গে বিবাহ ছাড়াই একসঙ্গে বসবাস করতে পারেন বা আলাদা থাকতে পারেন। এ রকম নানা পরিস্থিতি আছে। আর এ কারণেই একজন সঠিক সঙ্গী খুঁজে পাওয়া অনেক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

দ্বিতীয় কারণ হলো, সঙ্গীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। প্রেমের সম্পর্ক গবেষণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এলি ফিঙ্কেল। তিনি তাঁর এক গবেষণায় বলেছেন, ‘আমরা “আত্ম-বিবর্তনের” এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে আমরা সঙ্গীর কাছে সম্পর্কের বাইরে সবকিছু খুঁজছি। আমরা চাই, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে তারা আমাদের সমান হোক। আমরা চাই, নিজেদের চালু করা প্রতিষ্ঠানে তারা সিইও হোক, আমরা চাই তারা একজন দুর্দান্ত অভিভাবক হোক এবং আমরা চাই তারা একজন অসাধারণ যৌনসঙ্গী হোক।’

প্রযুক্তির কারণে অনেকেই নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়ে অভিভূত বোধ করেন
ছবি: পেক্সেলস

পল ব্রানসন আরও বলেছেন, ‘প্রযুক্তির কারণে অনেকেই নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়ে অভিভূত বোধ করেন। এই পছন্দ বা সঙ্গী নির্বাচনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে আমরা নিজেদের বোকা বানিয়ে ফেলি। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের কাছে একজনের অসংখ্য বিকল্প আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আপনি যদি ১০০টি ডেটিং অ্যাপ ডাউনলোড করেন, তাহলে এক সপ্তাহে কারও সঙ্গে দেখা হওয়ার কতগুলো তারিখ পাওয়া সম্ভব? বিষয়টি অনেক সীমিত। তাই আমরা যতটা বিশ্বাস করি, ততটা বিকল্প আমাদের হাতে নেই।’

ডেভিড রবসন, ব্রানসনের কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘আপনি বইয়ে উল্লেখ করেছেন, মানুষ তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে প্রকৃতপক্ষে কম খুশি। আবার বলেছেন, ২০ শতাংশ মানুষ, যাঁরা সঙ্গীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি খুশি ছিলেন; তাঁরা আরও বেশি সন্তুষ্ট হচ্ছেন। এটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?’

জবাবে ব্রানসন বলেছেন, ‘অনেক বিয়েতে মানুষের সন্তুষ্টি কম। এর অনেক কারণ আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, আমরা জানি, আমাদের আরও অনেক বিকল্প আছে। বিশ্বাস করি, ঘাস আরও সবুজ হতে পারে এবং আমরা আরও অনেক কিছু জানি।’

সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ

সঙ্গীর কাছে মানুষের প্রত্যাশা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি
ছবি: পেক্সেলস

সম্পর্ক নিয়ে এখন অনেক মানুষই অসন্তুষ্ট। সম্পর্কের ভেতর অহেতুক সন্দেহ ঢুকে যাচ্ছে। তবে কিছু মানুষ ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য অসন্তুষ্টি খুঁজে বের করছেন। তাঁরা নিজেদের সম্পর্কের ভেতরের শূন্যতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন, যাতে সম্পর্ক আরও পোক্ত হয়। একে অপরকে তাঁদের কল্যাণে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করছেন। এর অর্থ হলো, সম্পর্কে উচ্চ সন্তুষ্টি আছে এমন মানুষের সংখ্যা নগণ্য।

ব্রানসন প্রেম বা সম্পর্কের রকমফেরের কথা বলেছেন। সম্পর্কের বিষয়টি শৈশবের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত। শৈশবের অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত বয়সে গিয়ে সম্পর্কে প্রভাব ফেলে।

ব্রানসন বলেছেন, শৈশবে যিনি যত্ন নেন, যাঁর সান্নিধ্য বেশি পাওয়া যায়, তাঁকেই শিশু নিরাপদ মনে করে। এটা হলো নিরাপদ সম্পর্ক। আবার লালন–পালনকারী যদি ঘর ছেড়ে চলে যান এবং পরে ফিরে আসেন, তবে তাঁদের প্রতি মানসিকতা আগের অবস্থানে নিয়ে আসা কঠিন। কারণ, শিশুরা উদ্বিগ্ন থাকে। তাদের উদ্বেগ থাকে লালন–পালনকারী আবার চলে যেতে পারেন। আরেকটি হলো, পরিহারকারী সম্পর্ক। এতে লালন–পালনকারী যদি ঘর ছেড়ে চলে যান এবং আবার ফিরে আসেন, তাহলে শিশুটি আর তাঁকে নিরাপদ মনে করে না। এ কারণে শিশুটি নিজের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে। আর চতুর্থ সম্পর্ক হলো ‘বিশৃঙ্খল’। এটি পরিহারকারী ও উদ্বিগ্নতার সংমিশ্রণ।

আমরা শিশুদের সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক রক্ষা করি, একইভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো প্রিয়জনের সঙ্গেও তা করি। তাই যখন কারও উদ্বিগ্ন সম্পর্ক বা পরিহারকারী সম্পর্ক থাকে, তাঁরা সাধারণত মানসিকভাবে সঙ্গীর খোলামেলা হবেন না। এ কারণে নিরাপদ সম্পর্কই সব সময় স্বাস্থ্যকর। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক পার্থক্য ও সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

অনলাইন ডেটিং পদ্ধতির ত্রুটি

অনলাইন ডেটিংয়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ত্রুটি আছে। তবে অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে। জনপ্রিয় ডেটিং অ্যাপ টিন্ডার এখন সম্পর্কের লক্ষ্য নির্বাচন করতে দেয়। কারণ, কেউ হয়তো দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের জন্য সঙ্গী খুঁজছেন, আর আরেকজন স্বল্পমেয়াদি সঙ্গী খুঁজছেন। এই দুজনের মধ্যে সম্পর্ক হলে তা হবে ওই সম্পর্কের জন্য বিপর্যয়কর।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো ছবি। এসব অ্যাপে ব্যবহারকারীর সাম্প্রতিক ছবি থাকে না। তাই যখন তাঁরা দিন ঠিকঠাক করে দেখা করতে যান, তখন তাঁদের আর ওই ছবির মতো দেখায় না। এটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই ব্যবহারকারীর সাম্প্রতিক সময়ের ছবিসহ তিন থেকে পাঁচটি ছবি থাকা উচিত।

প্রজন্মের পার্থক্য

বর্তমানে সম্পর্কের ভেতর অহেতুক সন্দেহ ঢুকে যাচ্ছে
ছবি: পেক্সেলস

এক দেশ বা এক শহরের ‘জেন জি’ (১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত যাঁদের জন্ম) অন্য কোনো দেশ বা শহরের ‘জেন জি’র চেয়ে আলাদা হতে পারেন। তাঁদের মধ্যে প্রজন্মগত পার্থক্য আছে। তবে তাঁরা সবাই সততার মূল্য দেন। টিন্ডারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাঁরা ওই সঙ্গীর সঙ্গে দ্বিতীয় ডেট চান কি না বা সঙ্গীর সঙ্গে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন কি না, এমন প্রশ্নে আগের সব প্রজন্মের মধ্যে সঙ্গীর শারীরিক আকর্ষণ ছিল এক নম্বরে। আর বর্তমানে জেন জিদের কাছে সঙ্গীর প্রতি শারীরিক আকর্ষণ দুই নম্বরে আছে।