পুতিন কেন ইরানে, নেপথ্যের কয়েক কারণ

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান (বাঁ থেকে)
ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আজ মঙ্গলবার তেহরানে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পাশাপাশি ‘আস্তানা ফরম্যাটে’ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের। খবর আল-জাজিরার।

সিরিয়ার বিষয়ে মতপার্থক্য দূর করতে ‘আস্তানা কাঠামোয়’ ত্রিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে আসছে এই তিন দেশ। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এবারের সম্মেলনে আরও অনেক বিষয় আলোচনায় স্থান পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এ ছাড়া দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন তিন নেতা ও তাঁদের প্রতিনিধিদল। এতে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে ২০১৫ সালে করা ইরানের পরমাণু চুক্তি নিয়েও আলোচনা হতে পারে। মোটাদাগে যেসব বিষয় এবারের বৈঠকে স্থান পাবে—

সিরিয়া পরিস্থিতি

এমন সময় তেহরান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন সিরিয়া নিয়ে রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে তুরস্কের উত্তেজনা চলছে। ‘সন্ত্রাসী’ কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে উত্তর সিরিয়ার অন্তত দুটি শহর লক্ষ্য করে শিগগিরই নতুন সামরিক অভিযান চালানো হবে বলে গত ১ জুন ঘোষণা দেয় তুরস্ক।

রাশিয়া ও ইরান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সবচেয়ে বড় দুই সমর্থক। ১০ বছরেরও বেশি আগে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে এখনো ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

তাল রিফাত ও মানবিজ থেকে কুর্দি যোদ্ধাদের বিতাড়িত করে চুক্তি অনুযায়ী ৩০ কিলোমিটার ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ বাস্তবায়নের কথা বলছেন এরদোয়ান। তবে হামলা থেকে বিরত থাকতে আঙ্কারার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মস্কো ও তেহরান। তুরস্কের এ পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্রও।

সম্প্রতি ন্যাটোর সদস্যপদ কাজে লাগিয়ে সিরিয়ার কুর্দি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান আরও পোক্ত করেছেন এরদোয়ান। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানে সমর্থন দিয়েছে আঙ্কারা। বিনিময়ে কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন বন্ধ এবং তুরস্ক সন্ত্রাসী মনে করে এমন কয়েক ডজন ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণের শর্ত দেওয়া হয়েছে।

ইউক্রেন ইস্যুতে তুরস্ক ও ইরানের অবস্থান

প্রতিবেশী ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ ও কিয়েভের ন্যাটোতে যোগদানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঠেকানোর কথা বলে গত ফেব্রুয়ারিতে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া। এর পর থেকে তেমন বিদেশ সফর করছেন না পুতিন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় এরদোয়ান একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করেছেন। তুরস্ক ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। আবার রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করছে। একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির লক্ষ্যে মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে মধ্যস্থতারও চেষ্টা করেছিল আঙ্কারা।

আবার একই সময় ইউক্রেনের কাছে বায়রাকতার কমব্যাট ড্রোন বিক্রি করেছে তুরস্ক। এসব ড্রোন যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে রাশিয়া। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করারও বিরোধিতা করেছিল তুরস্ক।

এরপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য খাতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছে তুরস্ক। রুশ পর্যটকদের ওপরও বহুলাংশে নির্ভরশীল আঙ্কারা।

অন্যদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে রাজি হয়নি ইরান। এ সংঘাতের মূলে ন্যাটোর আধিপত্য বিস্তারের নীতিকে দায়ী করেছে তেহরান।

তবে একই সময় যুদ্ধের বিরোধিতা করে আসছে ইরান। সংঘাত বন্ধে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। একাধিক সময় ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে বার্তা বাহকেরও ভূমিকা পালন করেছে তেহরান।

রাশিয়ার কাছে কি ড্রোন বিক্রি করবে ইরান

পুতিন এমন সময় তেহরান সফর করছেন, যখন রাশিয়ার কাছে ইরান ‘কয়েক শ’ সশস্ত্র ড্রোন বিক্রি করতে চায় বলে অভিযোগ করেছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। এসব ড্রোন ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করা হবে বলেও তিনি দাবি করেন।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসে মধ্য ইরানের একটি বিমানঘাঁটি অন্তত দুই দফা পরিদর্শনে গিয়েছেন একটি রুশ প্রতিনিধিদল। সেখানে তাঁরা অস্ত্র বহনে সক্ষম দুটি মডেলের ড্রোন দেখেছেন।

এ বিষয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ক্রেমলিন। তবে তেহরান সরাসরি এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলছে, ইউক্রেন সংঘাতে কোনো পক্ষকেই সামরিক সহায়তা দেবে না ইরান। কারণ, এ যুদ্ধের অবসান চায় তেহরান।

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক কি উত্তপ্ত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষ করার কয়েক দিন পরই ইরানে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সফরে ইরানের চিরশত্রু ইসরায়েল ও প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব সফর যান তিনি। এতে তেহরানের পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াই এসেছে।

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি পরামর্শদাতা সংস্থা গালফ স্টেট অ্যানালিটিকসের প্রধান জর্জিও ক্যাফিয়েরোর মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ‘ক্রমবর্ধমান পূর্ব-পশ্চিম বিভাজনের’ প্রেক্ষাপটে পুতিন ও এরদোয়ানের ইরান সফরকে ব্যাখ্যা করা গুরুত্বপূর্ণ।

জর্জিও ক্যাফিয়েরো বলেন, যুদ্ধের মাত্রা বাড়ছে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিতে আঘাত করতে শুরু করেছে। অপশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চাচ্ছে মস্কো, যেসব দেশ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করেনি।

ক্যাফিয়েরো আরও বলেন, ‘মস্কোর বিষয়ে ওয়াশিংটনের প্রতি শক্তিশালী বার্তা দেওয়া হয়েছে। সেটা হলো মার্কিন নীতি, অবস্থান ও যেসব বিষয় তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার বাইরে গিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী তেহরান ও আঙ্কারা।’

আরও যেসব বিষয়ে আলোচনা হতে পারে

নুর-সুলতান সংলাপের পাশাপাশি তিন নেতা গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সংলাপেও বসতে পারেন। কাজাখস্তানের নতুন রাজধানী নুর-সুলতান। আগে রাজধানীর নাম ছিল আস্তানা। তখন এটি আস্তানা সংলাপ নামে পরিচিত ছিল।

ইউক্রেন থেকে নিরাপদে শস্য রপ্তানিসহ পুতিন ও এরদোয়ান জ্বালানি, বাণিজ্য ও সম্পর্কোন্নয়নে অন্যান্য উপায় নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।

আরও পড়ুন

একই সময়ে দুই দেশের সঙ্গেই ২০ বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তি সইয়ে আগ্রহী ইরান। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এ প্রস্তাব দিয়ে আসছিল তেহরান।

ওয়াশিংটনের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি ভুগছে। এর প্রভাব মোকাবিলায় আঞ্চলিক কূটনৈতিক পদক্ষেপের ওপর জোর দিচ্ছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট। রাশিয়া ও তুরস্কের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে চায় ইরান। মস্কোর সঙ্গে দেশীয় মুদ্রা ব্যবহারের বিষয়েও আলোচনা করছেন কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুন