ইসরায়েলের অভিযানে কেন এত ফিলিস্তিনির প্রাণ ঝরছে

‘ব্রেক দ্য ওয়েভ’ নামে নিয়মিত পশ্চিম তীরে অভিযান চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী
ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে এখন প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। অভিযানে হতাহত হচ্ছেন অনেক ফিলিস্তিনি। গত বছরও এখানে অভিযান চালিয়েছিলেন ইসরায়েলি সেনারা। সেবারের অভিযানেও অনেক ফিলিস্তিনি প্রাণ হারান।

সম্প্রতি ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনের বিভিন্ন শহর, বিশেষ করে জেনিন ও নাবলুসে রাতের আঁধারে যে অভিযান শুরু করেছে, তাতে প্রাণহানি বাড়ছেই। ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র প্রতিরোধ ভাঙার নাম করে সাম্প্রতিকতম এ অভিযান শুরু করেছে তারা।

এ অভিযানকালে ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন সাধারণ ফিলিস্তিনিরাও। এসব ফিলিস্তিনির পাশাপাশি প্রাণ হারাচ্ছেন সংঘর্ষে না জড়ানো পথচারীরা। আবার সংঘর্ষে জড়িয়ে ও কখনো আগে থেকে নিশানায় থাকা ফিলিস্তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ যোদ্ধারা নিহত হচ্ছেন।

ইসরায়েলের জবরদখল করা পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে গত বছর তাদের সেনাদের হাতে ১৭০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৩০ শিশু ছিল। আর চলতি বছর শুধু জানুয়ারি মাসেই এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২৯ জন। তাঁদের মধ্যে শিশু পাঁচটি।

জাতিসংঘ বলেছে, ২০০৬ সালের পর ফিলিস্তিনিদের জন্য সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ের বছর ছিল ২০২২। কিন্তু চলতি ২০২৩ সালের শুরুতেই যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে এ বছর হয়তো গত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে পুরোদমে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে ইসরায়েলে নতুন উগ্র ডানপন্থী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ সম্ভাবনা বেড়ে গেছে বহুগুণ। গত ডিসেম্বরে দেশটিতে ক্ষমতায় এসেছে তারা।

সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে

১. ২০২১ সালের মে মাসে ফিলিস্তিনিদের গণবিক্ষোভের পর থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ওই বিক্ষোভ গোটা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ও ইসরায়েলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

২. দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররাহ থেকে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদের প্রতিবাদে শুরু হয় ওই বিক্ষোভ। এর জেরে ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ও ইসলামিক জিহাদ।

৩. এই দুই গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত যোদ্ধাদের নিশানা করে পশ্চিম তীরে দমন অভিযান চালিয়ে আসছে ইসরায়েল।

৪. গত বছরের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে ইসরায়েলে ফিলিস্তিনিদের ব্যক্তিগত পর্যায়ের বেশ কয়েকটি হামলায় নিহত হন ১৯ জন।

ইসরায়েলি অভিযানে শিশুসহ নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদেরও প্রাণ ঝরছে
ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলের এখনকার কৌশল কী

১. ২০০৫ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (গণবিক্ষোভ) শেষ হওয়ার পর পশ্চিম তীরের সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন বহুলাংশেই দমন করতে সক্ষম হয় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) ও ইসরায়েল। তবে ২০২১ সালে জেনিন শহর ও এর শরণার্থীশিবির ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র প্রতিরোধের কেন্দ্র হিসেবে আবার আবির্ভূত হয়। একই পথে হাঁটে নাবলুসও।

২. এরপর ২০২২ সালের মার্চে ‘ব্রেক দ্য ওয়েভ’ নামে নতুন সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। এ অভিযানই বেশিসংখ্যক ফিলিস্তিনির হতাহতের জন্য সরাসরি দায়ী।

৩. ইসরায়েল বলছে, তাদের অভিযানের লক্ষ্য সশস্ত্র যোদ্ধারা। তবে অভিযানে প্রায়ই শিশুসহ নিরস্ত্র বেসামরিক ফিলিস্তিনিরা নিহত হচ্ছেন।

৪. গত বছর অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় হামলা চালায় ইসরায়েল। আগস্টে তিন দিনের হামলায় ১৭ শিশুসহ ৪৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন।

পশ্চিম তীরে আত্মপ্রকাশ করা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কারা

গত বছরের সেপ্টেম্বরে হাতে গোনা কয়েকটি সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠী নিজেদের ‘জেনিন ব্রিগেডস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। আরও কয়েকটি গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নাবলুস ব্রিগেডস, লায়নস ডেন, বালাতা ব্রিগেডস এবং অতিসম্প্রতি জেনিনে আত্মপ্রকাশ করা ইবাদ ব্রিগেডস।

সংখ্যায় অল্প হলেও এসব সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর সদস্যরা ইসরায়েলি বাহিনীর সামরিক ও গ্রেপ্তার অভিযানের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযানের সময় তারা পাল্টা গুলি ছোড়ে এবং সশস্ত্র লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে।

এসব গোষ্ঠীর যোদ্ধারা ইসরায়েলি তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়ে থাকেন। এতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরায়েলি সেনা ও অবৈধ ইহুদি বসতিস্থাপনকারীদের মধ্যে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত একটি বাড়ি
ছবি: রয়টার্স

নতুন ইসরায়েলি সরকারের অধীন আসা কিছু পরিবর্তন

সামরিক অভিযান ও নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বাড়ানো ইয়ার লাপিদের নেতৃত্বাধীন বিদায়ী মধ্যপন্থী সরকারের একটা কৌশল ছিল। ওই সময় ফিলিস্তিনিদের ওপর বসতিস্থাপনকারীদের হামলা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, বিশেষ করে নাবলুসে।

এ ধরনের হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী তেমন কিছুই করেনি বলে অভিযোগ ওঠে। অন্যদিকে পশ্চিম তীরের উত্তরাংশে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বড় ধরনের দমন অভিযান চালানোর দাবি জানায় বসতিস্থাপনকারীরা।

ইসরায়েলের নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উগ্র ডানপন্থী সদস্যদের সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। তাঁদের একজন ইতামার বেন-গভির। তিনি ১৯৯৪ সালে ইব্রাহিমি মসজিদে ২৯ ফিলিস্তিনিকে হত্যাকারী ইহুদি বারুচ গোল্ডস্টেইনের প্রতি নিজের সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন।

বেন-গভির ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী। একই সঙ্গে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বর্ডার পুলিশ বিভাগও নিয়ন্ত্রণ করবেন তিনি।

আরেক উগ্র ডানপন্থী বেজালেল স্মোত্রিচকে কোগ্যাটের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এ সংস্থা পশ্চিম তীরে প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে।

আরও পড়ুন
ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে নিহত স্বজনের জন্য এক ফিলিস্তিনি বৃদ্ধের আর্তনাদ
ছবি: এএফপি

অভিযানের প্রতিক্রিয়া কী

অনেক ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের এসব সামরিক অভিযানের সমালোচনা করে আসছেন। কোনো ধরনের জবাবদিহি ছাড়া বেআইনি হত্যাকাণ্ড চালাতে ইসরায়েল সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ ফিলিস্তিনিদের।

কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিশেষ ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের একটি ছিল, গত ডিসেম্বরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় জেনিনে বাড়ির ছাদে থাকা ১৬ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি কিশোরীকে গুলি করে হত্যা।

আরও পড়ুন

এ ধরনের আরও হত্যাকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে স্কুলে যাওয়ার পথে ১৮ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থীকে হত্যা ও গাড়িতে থাকা ১৫ বছরের এক কিশোরকে হত্যা।

গত বছরের মে মাসে জেনিনে একটি সামরিক অভিযানের সংবাদ সংগ্রহের সময় আল-জাজিরার খ্যাতিমান ফিলিস্তিনি প্রতিবেদক শিরিন আবু আকলেহকেও হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের শুরু থেকে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলের প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে আসছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মী ও রাজনীতিবিদেরা।

আরও পড়ুন