আন্তর্জাতিক আদালতের পরোয়ানা থেকে নেতানিয়াহু কি সত্যিই দায়মুক্ত
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তাঁর সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন এই যুক্তিতে যে গাজায় ইসরায়েলের চলমান আগ্রাসনে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় তাঁদের আইনি দায় থাকতে পারে। ২১ নভেম্বর তাঁদের বিরুদ্ধে জারি করা হয় এ পরোয়ানা।
আইসিসির ওই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতারা সর্বোচ্চ এ আদালতের সিদ্ধান্ত সমুন্নত রাখা ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারে নিজেদের আইনি বাধ্যবাধকতা পূরণ করার কথা জানান। তাঁরা বলেন, তাঁদের দেশের মাটিতে নেতানিয়াহু পা রাখলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। তবে এই নেতাদের মধ্যে ব্যতিক্রম একজন। তিনি হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান। নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে তাঁকে হাঙ্গেরি সফরে উষ্ণ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি।
আইসিসির রোম সনদ অনুযায়ী, এ আদালতকে সহযোগিতা করা ফ্রান্সের দায়িত্ব। আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করাও এ দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
হাঙ্গেরির মতো ফ্রান্সও এখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও আইসিসির পরোয়ানার পর দেশটি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আদালতের আদেশ মেনে চলবে বলে জানিয়েছিল। তবে এর পর থেকে প্যারিসের সুর পাল্টেছে। প্যারিস ইঙ্গিত দিয়েছে, ইসরায়েল ‘আইসিসির সঙ্গে যুক্ত নয়’। তাই ওই পরোয়ানা থেকে নেতানিয়াহু অব্যাহতি পাওয়ার যোগ্য।
ফ্রান্সের ইউরোপ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্প্রতি একটি বিবৃতিতে বলেছে, ‘প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তাঁর অন্য মন্ত্রীদের দায়মুক্তি পাওয়ার বিষয় বিবেচনায় নেওয়া উচিত। তাঁদের গ্রেপ্তার ও তুলে দিতে আদালতের আদেশের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা উচিত।’
কিন্তু ফ্রান্সের এ অবস্থান কি আইনসম্মত, উঠেছে সে প্রশ্ন। এর জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছে আল–জাজিরা—
ফ্রান্সের দাবি অনুযায়ী, নেতানিয়াহু কী আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থেকে দায়মুক্ত? এককথায় এর জবাব হলো, না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রোম সনদের ভিত্তিতে। সনদের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এ আদালতের আদেশ কোনো পার্থক্য ছাড়াই সব ব্যক্তির জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য এবং তা কোনো অবস্থায় একজন ব্যক্তিকে অপরাধমূলক দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেবে না।
এমন প্রেক্ষাপটে নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) যুক্তরাজ্যের পরিচালক ইয়াসমিন আহমেদ বলেন, ‘আইসিসির রোম সনদ অনুযায়ী, এ আদালতকে সহযোগিতা করা ফ্রান্সের দায়িত্ব। আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করাও এ দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।’
হাঙ্গেরির মতো ফ্রান্সও এখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও আইসিসির পরোয়ানার পর দেশটি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আদালতের আদেশ মেনে চলবে বলে জানিয়েছিল। তবে এর পর থেকে প্যারিসের সুর পাল্টেছে। প্যারিস ইঙ্গিত দিয়েছে, ইসরায়েল ‘আইসিসির সঙ্গে যুক্ত নয়’। তাই ওই পরোয়ানা থেকে নেতানিয়াহু অব্যাহতি পাওয়ার যোগ্য।
তাহলে ফ্রান্স কেন নেতানিয়াহুর দায়মুক্তির পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে
ফরাসি সরকার নেতানিয়াহুর দায়মুক্তির পক্ষে যে যুক্তি দিচ্ছে, তা দৃশ্যত রোম সনদের ৯৮ অনুচ্ছেদকে ঘিরে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো দেশ আন্তর্জাতিক আইনের অধীন তার বাধ্যবাধকতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ করতে পারে না...কোনো ব্যক্তির কূটনৈতিক দায়মুক্তির ক্ষেত্রে...যিনি তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।’
১২৪টির মতো দেশ আইসিসির রোম সনদ অনুমোদন করেছে, কিন্তু ইসরায়েল এতে স্বাক্ষর করেনি।
মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক উইলিয়াম শ্যাবাস এ বিষয়ে আল–জাজিরাকে বলেন, ফ্রান্সের অবস্থান কোনো না কোনোভাবে ‘গ্রহণযোগ্য যুক্তিভিত্তিক’ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ৯৮ অনুচ্ছেদের ফলে সৃষ্ট দ্ব্যর্থবোধক ওই বক্তব্য আদালত এরই মধ্যে ২০১৯ সালের আপিল চেম্বারের আদেশে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এ আদেশ আইসিসির সদস্য নয়, এমন দেশগুলোর জন্যও প্রযোজ্য।
এ ক্ষেত্রে সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। ইসরায়েলের মতো সুদানও রোম সনদের কোনো পক্ষ নয়। দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্য স্পষ্ট করে আদালত তাঁর উপসংহারে বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, (অভিযুক্ত ব্যক্তি) তৃতীয় কোনো পক্ষের হোক বা না হোক, তাঁকে দায়মুক্তি দেওয়ার সুযোগ নেই।
ফ্রান্সের বক্তব্য থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায়, দেশটি আইসিসির আদেশ সমুন্নত রাখতে না-ও পারে, যা হবে কোনো রাষ্ট্রের জন্য এ আদালতের আদেশ প্রত্যাখ্যান করার নামান্তর। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্যদেশগুলোর জন্য তা হবে ‘উদ্বেগজনক’।
উইলিয়াম শ্যাবাস বলেন, এর অর্থ হলো, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা সংক্রান্ত আইসিসির পরোয়ানা বিষয়ে ফ্রান্স একমত না হলেও তা প্রতিপালনে দেশটির আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এই অধ্যাপক সতর্ক করে বলেন, ফ্রান্সের বক্তব্য থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায়, দেশটি আইসিসির আদেশ সমুন্নত রাখতে না-ও পারে, যা হবে কোনো রাষ্ট্রের জন্য এ আদালতের আদেশ প্রত্যাখ্যান করার নামান্তর। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্যদেশগুলোর জন্য তা হবে ‘উদ্বেগজনক’।
নেতানিয়াহু দায়মুক্তির অধিকারী হলে পুতিনের ব্যাপারে ফ্রান্সের বক্তব্য কী
ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গত বছরের মার্চে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আইসিসি।
মাখোঁর সরকার এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘পদমর্যাদা যা-ই হোক, কোনো ব্যক্তি বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে রেহাই পেতে পারেন না।’
পুতিন চলতি বছরের আগস্টে সরকারি সফরে মঙ্গোলিয়ায় যান। কিন্তু দেশটি তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। এ ঘটনায় আইসিসি এক আদেশে বলেন, মঙ্গোলিয়া আইসিসির সদস্য হয়েও তার আইনি বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
ওই আদেশের পর ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিল, ‘আইসিসিকে সহযোগিতা এবং পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে রোম সনদভুক্ত প্রতিটি দেশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।’
অধ্যাপক শ্যাবাস বলেন, পুতিনকে গ্রেপ্তার করা বিষয়ে ফ্রান্সের এ বক্তব্য নেতানিয়াহুকে নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের বিপরীত। উল্লেখ্য, ফ্রান্স আইসিসির সদস্য। তিনি আরও বলেন, ফ্রান্সের যুক্তি কোনো ‘আইনি মূলনীতির’ ভিত্তিতে নয়; বরং দেশটি কাকে বন্ধু ও কাকে শত্রু বলে গণ্য করে, সেটির ওপর ভিত্তি করে দেওয়া।