সিরিয়ায় সাধারণ মানুষ হত্যার ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসছে
সিরিয়ার নতুন সরকারের অনুগত সশস্ত্র ব্যক্তিরাই আলাউইত সম্প্রদায়ের সদস্যদের মাঠে-ময়দানে হত্যা করেছে। এই নির্মমতার কারণ হিসেবে দেশকে ‘পরিশুদ্ধ করার’ লক্ষ্যের কথা বলেছেন তাঁরা। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও ভিডিও থেকে এমনটি জানা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও ভিডিওচিত্রে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ সরকারের অনুগতদের ওপর নিপীড়নের রোমহর্ষ দৃশ্য ফুটে উঠেছে। এটা কার্যত ‘সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডে’ রূপ নিয়েছে।
সশস্ত্র বিদ্রোহীদের আক্রমণের মুখে বাশার আল-আসাদ গত বছরের ডিসেম্বরে ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর গত বৃহস্পতিবার থেকে দেশটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। আলাউইতদের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দুটি প্রদেশে এই সহিংসতা হচ্ছে। এ বিষয়ে সিরিয়ার নতুন সরকারের বক্তব্য হলো, সাবেক সরকারের প্রতি অনুগত কিছু বিদ্রোহী এখনো রয়ে গেছে। তাদের শুরু করা বিদ্রোহ দমন করতে অস্ত্রধারীরা সেখানে ব্যবস্থা নিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের (এসএনএইচআর) তথ্যমতে, সহিংসতায় অন্তত ৬৪২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ রয়েছেন, যাঁদের অনেকে তরুণ ও যুবক। সরকারি বাহিনীগুলো ‘মাঠে-ঘাটে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড’ চালানোয় তাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন।
এসওএইচআরের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাতাকিয়া ও তারতুসে তিন দিনে আলাউইত সম্প্রদায়ের অন্তত ৭৪৫ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। সংঘাতে বাশারপন্থী যোদ্ধা নিহত হয়েছেন ১৪৮ জন। নতুন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছেন প্রায় ১২৫ জন।
সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা রোববার সহিংসতার জন্য আগের সরকারের বাহিনীর মধ্যে এখনো যাঁরা বাশারের অনুগত রয়ে গেছেন, তাঁদের দায়ী করেছেন। পাশাপাশি সাধারণ নাগরিক হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
আল-শারা বলেছেন, ‘এখনো আসাদ বাহিনীর যারা টিকে আছে, তাদেরকে আমরা সহ্য করব না। তাদের সামনে কেবল একটি পথ খোলা আছে, তা হলো অবিলম্বে আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করা।’
একই সঙ্গে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন আল-শারা। সাম্প্রতিক সহিংসতাকে তিনি ‘অনুমেয় চ্যালেঞ্জ’ বলে বর্ণনা করেছেন। সহিংসতার ঘটনা খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন এবং আক্রান্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছে তাঁর দপ্তর।
‘তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিল’
যে দুটি প্রদেশে হামলা হয়েছে, তার একটি লাতাকিয়া। এটি সিরিয়ার প্রধান বন্দরনগরী। এই শহরের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের ওপর হামলা চালাচ্ছিল। যেন এটা তাদের কাছে একধরনের বিনোদন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।...সমগ্র সিরিয়ায় তারা আমাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিল।’
এই বাসিন্দা ৩০ বছর ধরে লাতাকিয়ায় বসবাস করছিলেন। গত শনিবার তিনি শহরটি ছেড়ে পালিয়ে যান। তিনি সিএনএনকে বলেন, শুক্রবার (৭ মার্চ) ভোরে তাঁরা রাস্তায় মানুষের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
লাতাকিয়া শহরের আরেক বাসিন্দা বশির বলেন, ‘যাঁরা হত্যাকাণ্ড থেকে প্রাণে বেঁচে যান, তাঁরা পালাচ্ছিলেন। আমার ৭০ বছর বয়সী চাচা এবং তাঁর ৬০ বছর বয়সী স্ত্রীকে নিজেদের বাসায় ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। আমার চাচা ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক।’ নিহত এই দুই ব্যক্তিও আলাউইত সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের তারতুস প্রদেশের বানিয়াস শহরের বাসিন্দা।
‘আমি নিজের ও দুই সন্তানের জীবন নিয়ে ভয়ে আছি,’ বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বশির।
আলাউইত অধ্যুষিত বিভিন্ন শহরে নতুন সরকারের বাহিনীর ওপর বাশারপন্থীরা হামলা চালাচ্ছে, এমন খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার রাতে সরকার অনুগত সশস্ত্র ব্যক্তিরা দলে দলে লাতাকিয়া ও তারতুস প্রদেশের দিকে যাত্রা শুরু করেন।
৩৫ বছর বয়সী রাশা সাদেক জাতিগতভাবে আলাউইত। তিন সন্তানের এই জননী সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের হোমস প্রদেশে বাস করেন। রোববার তাঁর ভাইয়ের ব্যবসায়িক অংশীদার তাঁকে ফোন করে জানান, নতুন সরকারের সমর্থক সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা তাঁর মা ও দুই ভাইকে হত্যা করেছে। নিহতরা তারতুস প্রদেশের বানিয়াস শহরে থাকতেন।
হোমস প্রদেশের ওই নারী বলেন, ‘আমি সার্বক্ষণিক আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলাম। তাঁরা গোলাগুলির শব্দ শোনার কথা জানিয়েছিলেন।’ তিনি আরও বলেন, তাঁর পরিবারের সদস্যরা ধর্মীয় স্লোগান শোনার কথাও জানিয়েছিলেন। তাঁর পরিবার বাশারপন্থী ছিল না, ছিল সাধারণ মানুষ।
বাশার আল–আসাদের পরিবারও আলাউইত সম্প্রদায়ের। বাশারপন্থী যোদ্ধারাও আলাউইত সম্প্রদায়ের সদস্য। এটি শিয়াধর্মাবলম্বীদের একটি শাখা। সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলেই এই সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষ বাস করেন। কিন্তু এই সম্প্রদায়ের অধিকাংশের সঙ্গে বাশার পরিবারের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।
গত ডিসেম্বরে সুন্নি সশস্ত্র ইসলামপন্থীদের হাতে বাশার সরকারের পতনের আগে তাঁর পরিবার অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে সিরিয়া শাসন করেছে। নতুন শাসকেরা দেশটির রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক শৃঙ্খলা ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছে। নতুন শাসক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। দেশটির অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ও এইচটিএসের মূল নেতা আহমেদ আল-শারা আল-কায়েদার সাবেক সদস্য। ক্ষমতায় আসার পর তিনি রাজনৈতিক সমতা এবং জাতিগত ও ধর্মীয়ভাবে বৈচিত্র্যময় সিরিয়ার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন পর্যন্ত নতুন সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ আলাউইত। বাশার সরকারের আমলে তাঁদের দাপট ছিল। ডিসেম্বরে বাশারের পতনের পর এই সম্প্রদায়ের অনেকে অস্ত্র সমর্পণ করেছেন, তবে এখনো অনেকে তা করেননি।
বাশারপন্থীরা এইচটিএসের সদস্যদের ওপর গুপ্ত হামলা চালাচ্ছে এবং তাঁদের হত্যা করছে—এ খবর ছড়ানোর পর সরকারি বাহিনী পাল্টা হামলা শুরু করে। যে সশস্ত্র আক্রমণের মুখে বাশারের পতন ঘটে, সেই ঝটিকা হামলার নেতৃত্ব ছিল এই গোষ্ঠীর হাতে।
লাতাকিয়া শহরের বাসিন্দা বশির সিএনএনকে বলেন, ‘তারা [অস্ত্রধারীরা] যেসব গ্রামে হামলা চালিয়েছে, সেসব গ্রামের আসাদের অনুগতরা থাকত না। তারা এসব গ্রামে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে।’
সিরিয়ার সরকারি একটি সূত্র দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমকে বলেছে, ‘বিপুলসংখ্যক অসংগঠিত মানুষ’ ওই এলাকায় যাওয়ার পর সেখানে ‘ব্যক্তিগতভাবে আইন লঙ্ঘনের’ ঘটনা ঘটেছে।
সিরিয়া সরকার শনিবার সিএনএনকে বলেছে, বৃহস্পতিবার থেকে তাঁদের নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ১৫০ জন নিহত হয়েছে। বাশারপন্থীদের সঙ্গে সংঘাতের সময় ৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে হতাহতের সংখ্যা আলাদা করে নিশ্চিত করতে পারেনি সিএনএন।
‘পরিশুদ্ধির লড়াই’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বেশ কয়েকটি ভিডিওতে, ব্যাপক মাত্রার এই সহিংসতার আগে আগে গাড়ির বহর নিয়ে সশস্ত্র ব্যক্তিদের লাতাকিয়া ও তারতুসে যেতে দেখা যায়। সশস্ত্র ব্যক্তিদের বহরে থাকা এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘আগেরটি ছিল স্বাধীনতার লড়াই। এখন চলছে সিরিয়াকে পরিশুদ্ধ করার লড়াই।’ তবে ভিডিওটি ঠিক কখন ধারণ করা হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সামরিক পোশাক পরা এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘হেই আলাউইত, তোমাদের ও তোমাদের বাপদের হত্যা করার জন্য আমরা আসছি।’ রাতে ধারণা করা ওই ভিডিওতে এই ব্যক্তির উচ্চারণ মিসরীয় বলে মনে হয়েছে।
‘সবাই অস্ত্র নিয়ে বের হয়েছে। আমরা তোমাদেরকে সুন্নিদের [শক্তি] কেমন তা দেখিয়ে দেব।’ এই ভিডিও কোন জায়গায় ধারণা করা হয়েছে, তা নির্ধারণ করতে পারেনি সিএনএন। তবে ভিডিওটিতে বিপুলসংখ্যক গাড়ি দেখা গেছে।
বিপুলসংখ্যক এসব অস্ত্রধারী লাতাকিয়া ও তারতুসে যাওয়ার পরপরই ভয়াবহ সহিংসতার খবর আসতে শুরু করে। কিছু ভিডিওর স্থান নির্ধারণ করতে পেরেছে সিএনএন। এসব ভিডিও আল মুখতারেয়াহ গ্রামের। সেখানে মাটিতে শায়িত কয়েক ডজন মরদেহ ঘিরে লোকজনকে শোক করতে দেখা গেছে।
‘এরা সবাই আলাউইত শুয়োর’—একটি ভিডিওতে এক ব্যক্তিকে এই কথা বলতে শোনা যায়। খোলা মাঠে দেখতে একটি মরদেহকে গুলি করার আগে তিনি এই উক্তি করেন। কোথায় বা কখন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা স্পষ্ট নয়।
সিরিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়ানো আরেকটি ভিডিওতে সামরিক পোশাক পরা এক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেলে চড়ে একটি ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়। ওই ঘরের এক বাসিন্দাকে হত্যা করার আগে তাঁকে ক্যামেরার দিকে তাকাতে বলেন ওই অস্ত্রধারী।
অস্ত্রধারী হাসতে হাসতে বলেন, ‘গাদ্দার, আমি তোকে ধরে ফেলেছি।’ ওই ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে আবারও গুলি করার আগে অস্ত্রধারী বলেন, ‘এখনো তুই মরিসনি? তোর এখনো মৃত্যু হয়নি?’
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, সামরিক পোশাক পরা এক ব্যক্তি একটি ভবন থেকে এক জিম্মিকে বের হতে বলেন। নির্মমভাবে গুলি করে মারার আগে তাঁকে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করতে নির্দেশ দেন তিনি।
ওপরে উল্লেখ করা দুটি ভিডিওর কোনোটির সত্যতা সিএনএন যাচাই করতে পারেনি। কিন্তু গত কয়েক দিনে সিরিয়ায় যেসব ভিডিও বের হয়েছে, এই দুটি সেগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এসব ভিডিওতে ক্যামেরার সামনে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে।
এসব হামলা সিরিয়ার বর্তমান সরকারের ওপর বড় প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। এই শাসকগোষ্ঠী অতীতে জিহাদি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে নিজেদের তা থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করছে।
বশির বলেন, ‘তিন মাস আগ থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে, তা পাঁচ দশকে আসাদরা [বাশার আল-আসাদ ও তাঁর বাবা হাফিজ আল-আসাদ] যা করেছেন, তার সঙ্গে তুলনীয়। আসাদরা অপরাধী ছিলেন। এরাও (নতুন শাসকেরা) অপরাধী।’
মোস্তফা সালেম সিএনএনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন। এর আগে তিনি রয়টার্সের আঞ্চলিক ভিডিও সংবাদ প্রযোজক ছিলেন। প্রতিবেদনটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ তাসনিম আলম।