ফিরে দেখা
নিরীহ কৃষক পরিবারের সন্তান সাদ্দাম হয়ে উঠলেন ইরাকের প্রতাপশালী শাসক
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ১৯৭৯ সালের ১৬ জুলাই রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেন। এরপর টানা প্রায় ২৫ বছর তিনি ইরাক শাসন করেন। ইরাকে তথাকথিত গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত আছে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকে হামলা চালানো হয়। উৎখাত করা হয় তাঁর সরকারকে।
সাদ্দাম হোসেন, ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট। প্রায় ২৫ বছর দেশ শাসন করেছেন তিনি। আরবদের চোখে প্রতাপশালী শাসক আর পশ্চিমাদের কাছে তিনি ছিলেন একজন স্বৈরাচার। একের পর এক যুদ্ধ করে, বেসামরিক মানুষের রক্ত ঝরিয়ে আলোচিত–সমালোচিত হন তিনি। পরিণতিও সুখকর হয়নি। একসময়ের আলোচিত রাষ্ট্রনায়ক প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে ছিলেন জন্মশহরের একটি সুড়ঙ্গে।
১৯৭৯ সালের আজকের দিনে (১৬ জুলাই) ইরাকে ক্ষমতার রদবদল ঘটে। রাষ্ট্রপ্রধানের পদে বসেন সাদ্দাম হোসেন। আসুন, ইরাকের রাজনীতিতে সাদ্দামের উত্থান, ক্ষমতায় আরোহণ, শাসনামলের খুঁটিনাটি, বিতর্ক, পতন ও পরিণতির বিষয়ে জেনে নিই—
শুরু থেকেই বাথ পার্টির সরকারে সাদ্দামের জোরালো অবস্থান ছিল। ১৯৭২ সালে তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সাদ্দাম। তবে ১৯৭৯ সালের দিকে সাদ্দাম ওই সরকারে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন। এর জেরেই পদত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট আহমাদ হাসান আল–বকর।
জন্ম গরিব পরিবারে
ইরাকের উত্তরাঞ্চলে তিকরিত শহরের পাশে ১৯৩৭ সালের ২৮ এপ্রিল এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে সাদ্দাম হোসেনের জন্ম। দেশটির অন্যতম দরিদ্র একটি এলাকা সেটা। সাদ্দামের জন্মের আগেই তাঁর বাবা মারা যান। বাগদাদে চাচার কাছে থেকে বড় হয়েছেন তিনি।
শৈশব থেকে দারিদ্রের মধ্য বেড়ে উঠেছেন সাদ্দাম। ফলে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে চাচার বাসায় আশ্রয় নেন। ২০ বছর বয়সে ইরাকের বাথ পার্টিতে যোগ দেন তরুণ সাদ্দাম। বছর দুয়েকের মাথায় ইরাকের প্রধানমন্ত্রীকে উৎখাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন সাদ্দাম ও তাঁর দলীয় সহযোগীরা। আহত অবস্থায় পালিয়ে যান সিরিয়ায়, এরপর মিসরে।
সাদ্দাম মিসরের কায়রো ল স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৯৬৩ সালে ইরাকে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে। দেশে ফিরেন সাদ্দাম। ভর্তি হন বাগদাদ ল কলেজে। ওই বছরই ক্ষমতা ছাড়তে হয় বাথ পার্টির সরকারকে। সাদ্দামকে কারাগারে যেতে হয়। কয়েক বছর বন্দী ছিলেন তিনি।
কারাগার থেকে বেরিয়ে আত্মগোপনে চলে যান সাদ্দাম। দলের নেতা হন তিনি। ১৯৬৮ সালে বাথ পার্টির অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসে। এতে নেতৃত্ব দেন সাদ্দাম। তবে ওই সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আহমাদ হাসান আল–বকর। ১৯৭৯ সালের এই দিনে তাঁকে সরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেন সাদ্দাম।
সাদ্দামকে তিকরিত শহরে দাফন করা হয়েছিল। ২০১২ সালের পর ইরাকের এ এলাকাটি সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দখলে চলে যায়। তখন কবর থেকে সাদ্দামের মরদেহ তুলে গোপন স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে তাঁর কবর কোথায়, তা কেউ জানেন না।
সরকারে হস্তক্ষেপ
তবে শুরু থেকেই বাথ পার্টির সরকারে সাদ্দামের জোরালো অবস্থান ছিল। ১৯৭২ সালে তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সাদ্দাম। তবে ১৯৭৯ সালের দিকে সাদ্দাম ওই সরকারে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন। এর জেরেই পদত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট আহমাদ হাসান আল–বকর।
উপসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল সাদ্দামের। এর প্রকাশ ঘটে ইরাক–ইরান, ইরাক–কুয়েতসহ বিভিন্ন যুদ্ধে। ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও ইরাকবিষয়ক বিশ্লেষক ফানার হাদ্দাদ আল–জাজিরাকে বলেন, সাদ্দাম নিজের একটি শক্তিশালী ভাবমূর্তির প্রকাশ ঘটাতে চাইতেন। আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি।
প্রায় ২৫ বছরের শাসনামলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরব ছিলেন সাদ্দাম। প্যান–আরব মনোভাবের কারণে বিশ্বাস করতেন, ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাত শুধু ফিলিস্তিনের বিষয় নয়। এটা আরব অঞ্চলের সমস্যা। তাই ফিলিস্তিনিদের হয়ে লড়াই করার অধিকার ইরাকিদের আছে।
হামলা করেন ইসরায়েলে
১৯৯১ সালের ১৮ জানুয়ারি ইসরায়েলে কয়েকটি স্কুড ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেন সাদ্দাম। তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিবে গিয়ে পড়ে। জেরুজালেমের বাসিন্দা, ৭২ বছর বয়সের মানাল মুস্তাফা আল–জাজিরাকে বলেন, ‘কোনো আরব নেতা যা করতে পারেননি, সাদ্দাম হোসেন সেটা করে দেখিয়েছেন। এ জন্য আমি তাঁকে সব সময় মনে রাখব।’
আঞ্চলিক পর্যায়ে সাদ্দামের জনপ্রিয়তা অনেকটাই বাড়িয়ে দেয় উপসাগরীয় যুদ্ধ। এ বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মামুন আল–আব্বাসি বলেন, ‘এ যুদ্ধ বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে দেখেছিলেন আরবরা।’
কিন্তু সাদ্দাম যখন কুয়েতে হামলা চালান, তখন তাঁর প্রতি সমর্থন অনেকটাই বদলে যায়। কেননা, তাঁর ও ইরাকের ওপর জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপ করে আর তাতে সংকটে পড়ে যায় ইরাকের অর্থনীতি। দারিদ্র্যপীড়িত ইরাকিদের অনেকেই সাদ্দামের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি।
অভিযোগের পাহাড়
সাদ্দামের বিরুদ্ধে দেশে ব্যাপক ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগ করে যুক্তরাষ্ট্র । বিশেষ করে শিয়া ও কুর্দিদের দমনে ব্যাপক শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ১৯৮০–এর দশকে শত শত কুর্দি গ্রামে ব্যাপক হামলা চালিয়ে অন্তত ১ লাখ কুর্দিকে হত্যা করার জন্য সাদ্দামকে দোষারোপ করেন পশ্চিমারা। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বেসামরিক কুর্দি।
এর মধ্যে ১৯৮৮ সালের ১৬ মার্চ কুর্দি গ্রাম হালাবজাতে হামলা চালিয়ে ৫ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, গ্রামটিতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন সাদ্দাম। এর আগে ১৯৮২ সালে শিয়াদের দুজাইল গ্রামে হামলা চালিয়ে ১৪৮ জনকে হত্যা করা হয়। এক সফরের সময় সাদ্দামকে হত্যাচেষ্টার প্রতিশোধ নিতে গ্রামটিতে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় বলে অভিযোগ।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকের সামরিক বাহিনীর বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ছিলেন সোবি তৌফিক। সামরিক এই কর্মকর্তা আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করার জন্য ইরাকিদের অনেকেই সাদ্দাম হোসেনকে পছন্দ করতেন। তবে যুদ্ধে হাজারো ইরাকি তরুণ হতাহত হওয়ার পর তাঁর প্রতি সমর্থন কমতে শুরু করেন।’
মার্কিন হস্তক্ষেপ
সাদ্দাম হোসের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সালের এপ্রিলে ইরাকে হস্তক্ষেপ করে ইঙ্গ–মার্কিন বাহিনী। সেই সঙ্গে পশ্চিমাদের অভিযোগ ছিল, সাদ্দামের ইরাক পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে।
হামলার মুখে বাগদাদ ছাড়েন সাদ্দাম। আত্মগোপনে চলে যান। ২০০৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর জন্মশহর তিকরিতের পাশে একটি সুড়ঙ্গ থেকে মার্কিন সেনারা সাদ্দামকে পাকড়াও করেন। সেখানে থাকা এক মার্কিন সেনার বরাতে রয়টার্স বলছে, ধরা পড়ার সময় সাদ্দাম নিজেকে ইরাকের প্রেসিডেন্ট পরিচয় দিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
রয়টার্সকে একজন মার্কিন জেনারেল বলেছেন, তাঁদের ধারণা ছিল, সাদ্দাম হোসেন দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবেন। প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। বরং একসময়ে প্রতাপশালী এ শাসক ‘ইঁদুরের মতো’ গর্তে লুকিয়ে ছিলেন।
সাদ্দামকে আটক করা সেনারা জানান, সুড়ঙ্গের ভেতরে ছোট্ট একটি কক্ষে ছিলেন তিনি। ওই কক্ষে পাশাপাশি দুটি বিছানা পাতা ছিল। ছোট্ট একটি ফ্রিজ ছিল। তাতে ছিল কয়েক ক্যান লেমনেড, একটি হটডগের প্যাকেট আর চকলেটের একটি খোলা প্যাকেট। কক্ষের মেঝেতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল নতুন কেনা কয়েক পাটি জুতা।
বিচার ও মৃত্যুদণ্ড
২০০৫ সালের অক্টোবরে সাদ্দামের বিচার শুরু হয়। চলে টানা ৯ মাস। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, সাদ্দামের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে। এ ছাড়া সন্ত্রাসী সংগঠন আল–কায়েদার সঙ্গেও সখ্য রয়েছে তাঁর। তবে এসব দাবি কখনোই প্রমাণ করতে পারেনি মার্কিন সরকার।
শিয়া ও কুর্দিদের গ্রামে হামলা চালিয়ে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধে সাদ্দামের মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়। পরের বছরের নভেম্বরে এ রায় দেন আদালত।
সেদিন ছিল পবিত্র ঈদুল আজহা। ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখ ৩০ ডিসেম্বর, ২০০৬। রাজধানী বাগদাদে সাদ্দামের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সে সময় সাদ্দামের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেছিলেন ইরাকের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকি।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর সাদ্দামের মরদেহ বাগদাদের সুরক্ষিত ‘গ্রিন জোন’ এলাকায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসার কাছে সড়কে ফেলে রাখা হয়েছিল বলে পরে এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন ইরাকের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-খাদিমি।
আল–খাদিমি জানান, সাদ্দামকে তিকরিত শহরে দাফন করা হয়েছিল। ২০১২ সালের পর ইরাকের এ এলাকাটি সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দখলে চলে যায়। তখন কবর থেকে সাদ্দামের মরদেহ তুলে গোপন স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে তাঁর কবর কোথায়, তা কেউ জানেন না।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, আল–জাজিরা ও ব্রিটানিকা