ইরানিদের জীবনযুদ্ধ, যে যুদ্ধে সাইরেন বাজে না
‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।’ আর যাঁরা বেঁচে যান? তাঁদের কাছে যুদ্ধ মানে আতঙ্ক, মৃত্যু, ধ্বংস, আহাজারি, পঙ্গুত্ব, খাদ্যসংকট, বিভীষিকা—মানুষের তৈরি সবচেয়ে ভয়াল সম্মেলন। এ সবকিছুর সঙ্গে সামলে নিতে তাঁদের প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির সঙ্গে, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলতে হয়। তার মানে রাজায় রাজায় যুদ্ধের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও একধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। যে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কোনো সাইরেন বাজানো হয় না।
ঠিক তেমনি ইসরায়েল আগ্রাসন চালানোর পর থেকে ইরানে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষদের জীবনে নেমে এসেছে ভয় ও অনিশ্চয়তা। সংঘাত শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সাধারণ ইরানিদের বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেট ও মুঠোফোন নেটওয়ার্ক বারবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে, বাজার প্রায় বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কে তেহরান ছাড়ছেন অনেকে। এ ছাড়া প্রতিদিন আরও নানা ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে ইরানিদের।
ধ্বংস ও হতাশা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে বলা হয়েছিল ‘আ ওয়ার টু এন্ড অল ওয়ারস’। কিন্তু সব যুদ্ধ শেষ করার জন্য এই যুদ্ধ হলেও ২০ বছর পেরোতে না পেরোতেই আবার যুদ্ধ দেখেছে বিশ্ববাসী। তার মানে, যুদ্ধ চলতেই থাকবে। যাঁরা যুদ্ধে গেলেন, যাঁরা ঘরে অপেক্ষা করলেন—সবাই যুদ্ধের ভেতর আরেক ভয়ংকর যুদ্ধ করে চলেছেন। নেটফ্লিক্সে ‘পিকি ব্লাইন্ডার্স’ নামে একটি ওয়েব সিরিজ আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় তৈরি এই সিরিজে বার্মিংহাম শহরকে দেখানো হয়েছে। এই গল্পের নায়ক যুদ্ধ শেষের একজন সৈনিক। তিনি প্রতি রাতে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেন, যেন এখনো বাংকারে শুয়ে আছেন। তাঁর বন্ধুও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন। মাঝে মাঝেই এই বন্ধু হিংসাত্মক হয়ে যান। সে সময় সামনে যাকে পান, তাঁকেই মেরে ফেলতে চান।
বৃহস্পতিবার সিএনএনকে ঠিক একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ইরানের ২৭ বছর বয়সী এক সেনাসদস্য। সামরিক শৃঙ্খলার কারণে তেহরানে তিনি ফোন বা অন্য কোনো ডিভাইস ব্যবহার করতে পারেন না। তিনি বলেছেন, ‘মনে হয় যেন একটা ক্ষেপণাস্ত্র আমার পিছু নিয়েছে। আমি কারাজ যাই, ওরা সেখানে বোমা মারে। তেহরানে ফিরি, ওরা এখানেও আঘাত হানে।’
দক্ষিণ ইরানের শিরাজ শহরে একটি সেলুনে কাজ করা একজন নারী বলেন, ‘আমি জানি না কী বলব! ভিডিও, ছবি দেখুন—মানুষ মারা যাচ্ছে, আমাদের দেশ লুটপাট হচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’
তেহরানের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে থাকা ২২ বছর বয়সী একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেন, ‘এত ধ্বংস মেরামত করতে দশক লেগে যাবে, তা–ও যদি সম্ভব হয়। আর এ খরচটা আমাদেরই বহন করতে হবে।’
অর্থের সংকট
সিএনএনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংঘাতকালীন অদ্ভুতভাবে চলছে ইরানিদের জীবন। পাড়ায় পাড়ায় দোকানপাট এখনো খোলা থাকলেও অনেকেই খরচ করছেন বাকিতে বা ঋণে। ব্যাংকগুলো থেকে চাহিদামতো নগদ অর্থ তোলা সম্ভব না হওয়ায় এই ঋণই এখন তাঁদের ভরসা।
নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইরানের এক ব্যক্তি বলেছেন, ব্যাংক থেকে রিয়াল তোলা সম্ভব না হওয়ায় এখন ঋণের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে। তাঁদের বিদ্যুৎ আছে। কিন্তু পেট্রল কোনো কাজে লাগছে না। কারণ, তেহরানের বাইরে যাওয়ার মতো তাঁদের কোনো জায়গা নেই।
শিরাজ শহরের ৫৫ বছর বয়সী একজন শিক্ষক বলেন, নগর কেন্দ্রের একটি ব্যাংকে শাখার সামনে ‘রিয়াল তোলার জন্য মানুষের বিশাল সারি’ দেখা গেছে। এসব নগদ অর্থ তোলার অনুরোধ সামাল দিতে ব্যাংকের কর্মীরা হিমশিম খাচ্ছিলেন। আতঙ্ক থেকেই মানুষ এসব করছে।
ফাঁকা দোকান, আতঙ্কিত হৃদয়
যেকোনো যুদ্ধ বা সংঘাতের বাড়তি চাপ বহন করতে হয় সাধারণ মানুষদের। বৃহস্পতিবার দ্য ইনডিপেনডেন্টকে উত্তর-পূর্ব তেহরানের একজন স্থানীয় খাবার বিক্রেতা বলেছেন, ‘মানুষের মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। অভিভাবকেরা সন্তানদের নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আর যাঁদের হাতে সামান্য অর্থ আছে, তাঁরা এই কয়েক দিনেই কয়েক বছরের বুড়ো হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, দোকানগুলো থেকে বোতলজাত পানি ও প্যাকেটজাত খাবার দ্রুতই বিক্রি হয়ে গেছে। যারা কিনতে পারেনি, তারা এখন গভীর মানসিক ও আর্থিক চাপে আছে।
এই খাবার বিক্রেতা আরও বলেন, ‘যুদ্ধ শুধু বোমা আর ড্রোন দিয়ে মানুষকে আঘাত করে না। এটা মানসিক স্বাস্থ্যও ধ্বংস করে দেয়। প্রতিটি বিস্ফোরণে কতজন হার্ট অ্যাটাক বা নার্ভাস ব্রেকডাউনে আক্রান্ত হয়, কেউ জানে না। সরকার এসবের কোনো দায় নেবে না, কিন্তু আমরা আমাদের চোখে এসব দেখছি।’
দ্য ইনডিপেনডেন্টের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে জানিয়েছেন, দোকানগুলো থেকে বিস্কুটের মতো হালকা খাবারও শেষ হয়ে গেছে। দক্ষিণ তেহরানের মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি বলেন, কয়েকটি দোকান ঘুরে তিনি কেবল দুটি মুরগি কিনতে পেরেছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি খাবার দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ যুদ্ধকে এখন গায়ে লেগে থাকা বাস্তবতা হিসেবে অনুভব করছে।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ
দ্য ইনডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ জুন তেহরানের আলাদ্দিন মলে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে দিচ্ছেন। আবার এই দোকান খুলতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে তাঁরা জানেন না।
এই দৃশ্য শুধু আলাদ্দিন মলের নয়; তেহরানের পূর্ব থেকে পশ্চিম এবং অন্যান্য শহরের শপিং সেন্টারগুলোরও একই অবস্থা। ফারজাম স্ট্রিটের কাছে একজন পোশাক বিক্রেতা বলেন, ‘প্রায় সবাই দোকান বন্ধ করে ফেলেছে। কেউ কেউ শুধু দিনে অন্তত একটা পণ্য বিক্রির আশায় দোকান খোলা রাখছে। কারণ, কিছু বিক্রি না হলে রাতে হয়তো রুটি জুটবে না।’
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুরুর আগে থেকেই মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও করের চাপে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হিমশিম খাচ্ছিলেন। এখন এই সংঘাত সেই চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, তাঁর পাশের দোকানদার কয়েকজনের কাছ থেকে ধার করে ১০ লাখ তুমান (রিয়ালের একক) জোগাড় করেছেন কেবল খাবার কিনে রাখার জন্য। এই অর্থ হয়তো তিনি শোধও করতে পারবেন না।
বাড়ছে ভয়
ইরানে বোমা থেকে বাঁচার জন্য নির্ধারিত কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। ১৫ জুন শহর কর্তৃপক্ষ মেট্রোরেল স্টেশনগুলোকে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দিয়েছে এবং মানুষকে মসজিদে যেতে বলেছে। যদিও এসব ভূমি-উপরস্থ আশ্রয়কেন্দ্র কতটা সুরক্ষা দিতে পারে, তা অনিশ্চিত। দ্য ইনডিপেনডেন্টের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এর এক দিন পর ১৬ জুন সকালে তেহরানের মেট্রো স্টেশন বন্ধ দেখা গেছে। আর স্টেশনের বাইরে ছিল আতঙ্কিত মানুষদের ভিড়।
ইস্পাহানসহ অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা। চার দশক আগের যুদ্ধের পরও কেন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়নি—এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে মানুষের মনে।
তেহরান সিটি কাউন্সিলের প্রধান মেহেদি চামরান বলেন, ‘আমাদের এখনো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। এমনকি ১৯৮০–এর যুদ্ধেও যথাযথ অভিজ্ঞতা ছিল না।’
এসব কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে গ্লাস যেন না ভাঙে, এ কারণে জানালায় ক্রস আকৃতি করে টেপ লাগিয়ে দিচ্ছেন। তেহরানের নাজাফাবাদ এলাকার ৬০ বছর বয়সী এক নারী বলেন, ‘আমার মানসিক অসুস্থতা আছে। বিস্ফোরণের প্রতিটি শব্দে মনে হয়, আমার জীবনের অর্ধেকটা ঝরে যাচ্ছে।’ এই নারী আরও বলেন, তাঁর ৮৭ বছর বয়সী বাবাও ভয় চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিস্ফোরণের শব্দে তিনিও গভীরভাবে বিচলিত হন।
ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত
ইসরায়েলি হামলার কারণে অনেক ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এ কারণে ইন্টারনেট ও মুঠোফোন নেটওয়ার্ক বারবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
দেশটির উপযোগাযোগমন্ত্রী এক্সে বলেছেন, ‘আমরা চাই ইন্টারনেট থাকুক, কিন্তু এটা আমাদের হাতে নেই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইরানিপ্রবাসী বলেন, ‘আমার বাড়ির কাছে হামলা হয়েছিল। আমি পারিবারিক গ্রুপে খুদে বার্তা দিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা পৌঁছায়নি। তিন ঘণ্টা কোনো উত্তর পাইনি। পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।’
তেহরান ছাড়ছে মানুষ
বিবিসির মঙ্গলবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের কারণে আতঙ্কে ইরানের রাজধানী ছেড়ে চলে যাচ্ছে মানুষ। অধিকাংশই গাড়িতে, কেউ মোটরসাইকেল আর কেউবা হেঁটেই নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা করেছেন। পেট্রলপাম্পগুলোয়ও গাদাগাদি ভিড়। কোথাও তিলধারণের জায়গা নেই।
দ্য ইনডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্তে তেহরানবাসীর লম্বা সারি দেখা গেছে। বিশেষ করে তুরস্কগামী বাজারগানে। উড়োজাহাজ বন্ধ। তাই মানুষ গাড়ি বা বাসের ওপর নির্ভর করছে।
রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়তো একদিন থেমে যায়। কিন্তু এই সংঘাতেই শুরু হওয়া সাধারণের জীবনের ছোট ছোট যুদ্ধ কিছুতেই শেষ হয় না। মূল যুদ্ধ শেষে তাঁদের শুরু হয় বেঁচে থাকার নতুন আরেক যুদ্ধ।
তথ্যসূত্র: সিএনএন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট ও বিবিসি।