বিবিসির সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা
দামেস্কের কাছে দেখি পরিত্যক্ত ট্যাংক, রাস্তায় ফেলে রাখা সামরিক পোশাক
সিরিয়ায় টানা ৫৩ বছরের আল-আসাদ পরিবারের শাসনের অবসান ঘটেছে। গত রোববার বাশার আল-আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। সবশেষ ২৪ বছর ধরে তিনি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। স্বৈরাচার বাশার পালিয়ে যাওয়ার পর রাজধানী দামেস্কসহ সিরিয়াজুড়ে হাজারো মানুষ রাজপথে নেমে উল্লাস করেন, স্বাগত জানান বিদ্রোহীদের। দামেস্কের রাজপথে ঘুরে, মানুষের সঙ্গে কথা বলে নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন বিবিসির সাংবাদিক বারবারা প্লেট আসার। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—
আমরা যখন পৌঁছালাম, তখন রাস্তায় সারি সারি গাড়ি। অনেকের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। কেউ একজন বিদ্রোহীদের পতাকা ওড়াচ্ছিলেন। সবাই রাতারাতি দামেস্কের পতন আর সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে গেছেন। এ কারণে লেবাননে অবস্থান করা অনেক সিরীয় দামেস্কের নিকটবর্তী সীমান্ত ক্রসিং মাসনায় যেতে চাচ্ছিলেন।
প্রতিবেদনের কাজে সেখানে এক দিন অবস্থান করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। কিন্তু সিরিয়ায় সরকার পতনের খবর শোনার পর পরিকল্পনা বদলে ফেলি। রাতারাতি ছোট একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিই। মনে হয়েছিল, আমরা নিজেরাই হয়তো দামেস্কে পৌঁছে যেতে পারব।
উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে লম্বা একজন মানুষকে উল্টো পথে যাওয়ার চেষ্টা করতে দেখলাম। দেখলাম, কোঁকড়া চুলের মানুষটি কাঁদছেন। আলাপ করে জানলাম, তাঁর নাম হুসেইন। তিনি বাশার আল-আসাদের সমর্থক। এখন তিনিও ভয় পাচ্ছেন।
কথায় কথায় বললেন, ‘সিরিয়ায় এখন কী ঘটছে, আমরা আসলে সেটা জানি না। ওরা হয়তো আমাদের মেরে ফেলবে। খুবই বিশৃঙ্খল অবস্থা।’
ওই ব্যক্তি (হুসেইন) যদিও তাঁর পরিবারকে সঙ্গে আনতে পেরেছেন। তবে তাঁদের কারও কাছে সীমান্ত পেরিয়ে লেবাননে প্রবেশের জন্য বৈধ কাগজপত্র ছিল না।
যা–ই হোক, ঘণ্টাখানেক পর আমরা সিরিয়ায় প্রবেশ করি। দামেস্ক অভিমুখী রাস্তাটি বেশ প্রশস্ত।
দামেস্কের কাছাকাছি এসে দেখি, সামরিক জিপ আর ট্যাংক রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত পড়ে আছে। আরও পড়ে আছে সেনাদের ফেলে যাওয়া সামরিক পোশাক।
দামেস্কে ঢুকতেই রাস্তায় বেশ ভিড় দেখলাম, তবে দোকানপাট বন্ধ ছিল। লোকজন শহরের কেন্দ্রস্থল ইমায়াদ স্কয়ারে জড়ো হয়েছেন। বাবা-ছেলের পাঁচ দশকের বেশি সময়ের শাসনামলের পতনে উদ্যাপনে মেতেছেন অনেকেই। কেউ কেউ শূন্যে গুলি ছুড়ছেন। উল্লসিত মানুষের ভিড়ে আহত একটা ছোট ছেলেকেও দেখলাম।
বেসামরিক লোকজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ শান্তির চিহ্ন দেখাচ্ছেন। বলছিলেন, বাশার আল-আসাদ চলে গেছেন, এখন সবকিছু ভালো হবে, ভালোভাবে চলবে।
সেখানে ভিড়ের মধ্যে একজন বয়স্ক নারী কাঁদছিলেন। তাঁর পরিবারের অনেক সদস্য সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্টের আমলে নিহত হয়েছেন। অনেকে কারাগারে আছেন। নিজেই জানালেন তিনি। উঁচু কণ্ঠে প্রার্থনার মতো করেই বললেন, ‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। জালিমের পতন হয়েছে, জালিমের পতন হয়েছে!’
এক দম্পতির দেখা পেলাম। তাঁদের চারটা ছোট শিশু আছে। ওই মা-বাবা খুশিতে রীতিমতো ফেটে পড়ছিলেন। আলাপে ওই বাবা বলেন, ‘এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমরা খুবই খুশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বৈরাচারের এতগুলো বছর পেরিয়ে আমরা নিজেদের মতো করে জীবন কাটাতে পারব! ২০১৪ সালে আমরা কারাগারে ছিলাম। এখন আমরা সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা আমাদের লোকদের, যোদ্ধাদের কারণে জয় পেয়েছি। এখন আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ সিরিয়া গড়ার মুহূর্তে রয়েছি। সিরিয়া ছেড়ে যাওয়া ভাই-বোনদের এখন দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানাই। আমাদের হৃদয় আর ঘর আপনাদের স্বাগত জানাতে উন্মুখ হয়ে আছে বলেও মন্তব্য করেন ওই ব্যক্তি।’
দামেস্ক ছেড়ে বাশার আল-আসাদ কোথায় চলে গেছেন, এটা নিয়ে প্রায় সারা দিন ধোঁয়াশা ছিল। পরে রাশিয়া সরকার জানায়, তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন।
আমরা দামেস্কে বাশার আল-আসাদের প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যাই। এটা এখন পরিত্যক্ত, লুটপাট হয়েছে। মূল্যবান সবকিছুই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা লোকজনকে এখান থেকে আসবাব বের করে নিয়ে যেতে দেখলাম। কেউই তাঁদের বাধা দিল না। বিদ্রোহীরা তাঁদের স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু নিরাপত্তা দিতে পারেনি।
লুটপাটকারী ব্যক্তিরা আশপাশের ভবনগুলোতে ঢুকে পড়েছিলেন। ক্ষমতার পালাবদলের এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসনবিহীন সময়টায় অনিশ্চয়তা আরও গভীর হয়ে ওঠে।
আলা দাদৌচের বয়স ৩৬ বছর। তিন সন্তানের জনক তিনি। প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। কথা বলতে এগিয়ে গেলে বলেন, ‘তিনি এইমাত্র চলে গেছেন, আপনি জানেন ... এখন পালাবদল সঠিক আর কার্যকর উপায়ে হতে হবে।’
কে, বাশার আল-আসাদ? পাল্টা প্রশ্ন করি তাঁকে। জবাবে বলেন, ‘হ্যাঁ, দেখেন আমি এখনো তাঁর নাম নিতে ভয় পাচ্ছি!’ আরও বলেন, ‘আমাদের প্রেসিডেন্ট স্বার্থপরের মতো পালিয়ে গেছেন। তাঁর উচিত ছিল অন্ততপক্ষে নতুন প্রেসিডেন্ট না আসা পর্যন্ত এসব এলাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী বা পুলিশের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।’
একটু থামলেন তিনি। পরক্ষণেই বলেন, ‘আপনি জানেন, দুই দিন আগেও আমি তাঁকে (বাশার আল-আসাদ) এভাবে স্বার্থপর বলতে পারিনি। তখন বললে বড় সমস্যা হতো। এখন সবকিছু আলাদা।’
‘আপনি এখন ঠিকঠাক শ্বাস নিতে পারেন। আপনি ঘুরে বেড়াতে পারেন। নিজের মতামতও জানাতে পারেন। যেসব বিষয় আপনাকে বিরক্ত করে, ভয় না পেয়ে সেসব নিয়ে কথা বলতে পারেন। পরিবর্তন এসেছে। আশা করি, এসব ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। গৃহযুদ্ধের ১৩ বছর আমরা মিথ্যা আশার মধ্যে বেঁচে ছিলাম’—এমন মন্তব্য করলেন তিনি।
কাজেই বাশার আল-আসাদবিহীন সিরিয়া এখন উচ্ছ্বাস আর ভয়ের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান করছে। সিরিয়াবাসী বিশৃঙ্খলা নিয়ে তীব্র উদ্বিগ্নের মধ্যেও শান্তির প্রত্যাশা করছেন।