পানি-বিদ্যুৎ নেই, খাবারে টান, অবরুদ্ধ গাজায় বাড়ছে মানবিক সংকট

ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহত স্বজনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কাঁদছেন কয়েকজন নারী। গাজা, ১০ অক্টোবর
ছবি: এএফপি

ইসরায়েলের লাগাতার হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। মুহুর্মুহু হামলায় কেঁপে উঠছে পুরো গাজা। ধসে পড়ছে একের পর এক স্থাপনা। দেখা দিয়েছে চরম মানবিক সংকট।

টানা পাঁচ দিন ধরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় অসংখ্য ভবন ধসে পড়েছে। দেখা দিয়েছে খাবারের চরম সংকট। অনেক জায়গায় নেই বিদ্যুৎ। সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন গাজাবাসী। অনেকে জীবন বাঁচাতে পরিবার নিয়ে নিরাপদ জায়গায় পালিয়েছেন। অনেকে আশ্রয়শিবিরে উঠেছেন। সেখানেও হামলা হচ্ছে।

নাদিনে আবদুল লতিফের বয়স ১৩ বছর। পরিবারের সঙ্গে গাজার আল-রিমাল এলাকায় থাকে। নাদিনে বলে, ‘বিমান হামলা শুরুর পর থেকে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন নিরাপদ জায়গায় যেতে বলছেন। এর মধ্যেই গত সোমবার ইসরায়েল জানায়, আমাদের এলাকায় হামলা চালানো হবে। এরপরও আমরা কোথাও যাইনি। কারণ, আমাদের যাওয়ার মতো নিরাপদ কোনো জায়গা নেই।’

গাজা উপত্যকা হামাসের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই গাজায় বিমান হামলা শুরুর পরপরই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওয়ভ গ্যালান্ট বলেছেন, গাজাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করা হবে। খাবার, পানি, জ্বালানি, বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। ইওয়ভ গ্যালান্ট বলেন, ‘আমরা বর্বরদের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। সেই অনুযায়ী জবাব দেওয়া হবে।’

গত শনিবার থেকে নাদিনের বাবা নিহাদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি ইসরায়েলে কাজ করতেন। শনিবার থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলন হামাস। এরপর নিহাদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যদের কোনো যোগাযোগ হয়নি।

ইসরায়েলি বিমান হামলায় বিধ্বস্ত একটি ভবন। গাজা, ৭ অক্টোবর
ছবি: এএফপি

গাজা উপত্যকা হামাসের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই গাজায় বিমান হামলা শুরুর পরপরই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওয়ভ গ্যালান্ট বলেছেন, গাজাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করা হবে। খাবার, পানি, জ্বালানি, বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। ইওয়ভ গ্যালান্ট বলেন, ‘আমরা বর্বরদের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। সেই অনুযায়ী জবাব দেওয়া হবে।’

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, গাজায় দুই শতাধিক জায়গায় বিমান হামলা চালানো হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য, ইসরায়েলি হামলায় মৃত মানুষের সংখ্যা ৯০০ ছাড়িয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান থেকে বেছে বেছে আবাসিক ভবন, মসজিদে হামলা চালানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন

গাজার উত্তরাঞ্চলের আল-সুদানিয়া এলাকার বাসিন্দা তারিক আল-হিল্লু (২০)। গত রোববার সকালে তাঁর এলাকায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। তারিক বলেন, ‘হামলার সময় পরিবারের সদস্যরা চিৎকার করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। পরে যে যেদিকে পেরেছি, ছুটে পালিয়েছি। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি।’

তারিক আরও বলেন, ‘পূর্বসতর্কতা ছাড়াই হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। অনেক ভবন ধসে পড়েছে। প্রতিবেশী অনেকেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন। অনেকেই সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন, কিন্তু তাঁদের উদ্ধার করার উপায় ছিল না।’

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর গাজাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করার ঘোষণার সমালোচনা করেছে। মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, এ উদ্যোগ ‘সংঘবদ্ধ শাস্তি’ দেওয়ার শামিল, এটা যুদ্ধাপরাধ। এইচআরডব্লিউর আঞ্চলিক পরিচালক ওমর শাকির বলেন, ইসরায়েল ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

গাজার একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে গত সোমবার উদ্ধার করা হয়েছিল ছয় মাস বয়সী সামা আল-ওয়াদিয়াকে। বিমান হামলার পর প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল শিশুটি, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গুরুতর আহত শিশুটি পরে মারা গেছে।

ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় ৮৩টি বিদ্যালয়ে আশ্রয়শিবির খোলা হয়েছে। সোমবারের মধ্যে এসব শিবিরের ৯০ শতাংশ সক্ষমতা পূর্ণ হয়ে গেছে। ইসরায়েলি হামলায় ২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাদের অনেকেই এসব শিবিরে এসেছেন।

বিশ্বের জনবহুল এলাকাগুলোর একটি গাজা। ১৪০ বর্গমাইলের এ উপত্যকায় বসবাস করেন প্রায় ২৩ লাখ মানুষ। এসব মানুষের অর্ধেকই চরম খাদ্যসংকটে ভোগেন। দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবন কাটাতে হয় তাঁদের। এ তথ্য জানিয়েছে ইউএনআরডব্লিউএ।

আরও পড়ুন

জ্বালানি, সুপেয় পানি ও কিছু ক্ষেত্রে খাবারের জন্য ইসরায়েলের ওপর নির্ভর করতে হয় গাজাবাসীকে। ইসরায়েলের বেঁধে দেওয়া সময়ে, নির্ধারিত করিডর হয়ে গাজায় খাবার-পানি ঢোকে। হামাসের হামলার জবাবে গাজার ওপর কড়া অবরোধ আরোপ করেছে ইসরায়েল। ভূমি, সাগর ও আকাশপথে গাজায় পণ্য প্রবেশ করা দুরূহ। তবে কিছু ক্ষেত্রে মানবিক সহায়তা ও বাণিজ্যের জন্য দুটি সীমান্ত ক্রসিং উন্মুক্ত রেখেছে ইসরায়েল।

এ পরিস্থিতিতে গত সোমবার জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, ‘হামাসের হামলার আগে থেকেই গাজার মানবিক পরিস্থিতি ভয়ংকর ছিল। এখন এ পরিস্থিতি আরও দ্রুত খারাপের দিকে যাবে।’

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর গাজাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করার ঘোষণার সমালোচনা করেছে। মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, এ উদ্যোগ ‘সংঘবদ্ধ শাস্তি’ দেওয়ার শামিল, এটা যুদ্ধাপরাধ। এইচআরডব্লিউর আঞ্চলিক পরিচালক ওমর শাকির বলেন, ইসরায়েল ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

আরও পড়ুন

ইসরায়েলের বেসামরিক মানুষজনের ওপর হামাসের হামলারও সমালোচনা করেছেন ওমর শাকির। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করা, নির্বিচারে হামলা করা এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের জিম্মি করা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীন যুদ্ধাপরাধের শামিল।’

ইসরায়েলের বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত জাবালিয়া আশ্রয়শিবিরে চলছে উদ্ধার তৎপরতা। গাজা, ৯ অক্টোবর
ছবি: রয়টার্স

গাজায় খাবার প্রবেশ ও মানুষ চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি ক্রসিং ওরেজ ও কারেম শালোম। যুদ্ধ শুরুর পর দুটি ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। অন্যদিকে মিসর থেকে রাফাহ ক্রসিং দিয়ে গাজায় পণ্য, খাবার ও জ্বালানি নেওয়া হয়। ফিলিস্তিনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইয়াদ আল-বোজোম গতকাল মঙ্গলবার জানান, রাফাহ ক্রসিংয়েও হামলা হয়েছে।

আরও পড়ুন

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি গত রোববার জানিয়েছে, তাদের কাছে গাজাবাসীর জন্য এক মাসের খাবার মজুত আছে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, দ্রুত খাবারের জোগান দিতে না পারলে চরম সংকটে পড়বে গাজার মানুষ। গাজায় এখন বিদ্যুতের সংকট চরম রূপ নিয়েছে। এ অবস্থায় খাবার নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও দেখছে সংস্থাটি।

উদ্ভূত পরিস্থিতি চরম সংকটে ফেলেছে নাদিনে আবদুল লতিফ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের। নাদিনে বলে, ‘সোমবার থেকে পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কদাচিৎ বিদ্যুৎ আর ইন্টারনেট থাকছে। খাবার কেনার জন্য বাড়ি থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি দিন দিন চরম বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। যুদ্ধবিমানের শব্দ পেলে আমরা ঘরের ভেতর টেবিলের নিচে লুকিয়ে থাকছি।’

আরও পড়ুন