সরানো হচ্ছে ধ্বংসস্তূপ, বেরিয়ে আসছে লাশ

উদ্ধারকাজ ব্যাহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ।

ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি শিশু। গতকাল তুরস্কের কাহরামানমারাসে
ছবি: রয়টার্স

সিরিয়া ও তুরস্কের সীমান্তবর্তী এলাকায় গত সোমবার ভোরে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার পর তিন দিন পেরিয়ে গেছে। তবে যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ ভূমিকম্প রেখে গেছে, তাতে উদ্ধারকাজে এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। হতাহত এবং নিখোঁজ নারী–পুরুষ ও শিশুর সঠিক সংখ্যাটিও জানা যায়নি।

এদিকে এ উদ্ধারকাজের ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা। ভূমিকম্পের পর প্রাথমিকভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, সেসব নিতে দেরি হচ্ছে—তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও সেই কথা স্বীকার করেছেন।

আরও পড়ুন

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে গতকাল বুধবার

রাত ১টা পর্যন্ত (বাংলাদেশ সময়) ১১ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্কে মারা গেছেন ৯ হাজার ৫৭ জন। আর সিরিয়ায় ২ হাজার ৬৬২ জন।

৭ দশমিক ৮ মাত্রার এ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ছে দুই দেশেই। তুরস্ক ও সিরিয়া সরকারের হিসাব অনুসারে, প্রথম দিন শেষে মৃতের সংখ্যা ছিল আড়াই হাজারের বেশি। দ্বিতীয় দিন সে সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজার ছাড়িয়ে যায়। আর গতকাল এ সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল ১১ হাজার। লাশের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বজনহারা মানুষের কান্না; বাড়ছে ঘরবাড়ি হারানো লোকজনের দুর্ভোগও।

এমন এক পরিস্থিতিতে গতকাল তুরস্কের ভূমিকম্প ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। গতকাল তিনি কাহরামানমারাস শহরে যান। সেখান উদ্ধারকাজ চলছিল। তিনি যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তাঁর পেছন দিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স ছুটছিল সাইরেন বাজিয়ে। এরদোয়ান সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন, উদ্ধারকাজ চালাতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ভূমিকম্পের কারণে সড়ক ও বিমান যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এই সমস্যা হচ্ছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকাজের গতি বাড়বে।

আরও পড়ুন

এরদোয়ান বলেন, ‘আগামীকাল ও পরবর্তী দিনগুলোতে আমরা আরও ভালো করব। এখনো আমাদের জ্বালানিসংকট রয়েছে। তবে এই সংকট আমরা কাটিয়ে উঠব।’ এ ছাড়া তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ভূমিকম্পে যাঁরা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, তাঁরা কেউ গৃহহীন থাকবেন না।

এরদোয়ান এ আশা ব্যক্ত করলেও গৃহহীন মানুষ মাথাগোঁজার ঠাঁই পেতে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন ভূমিকম্পের তিন দিন পর গতকালও। এ ছাড়া খাবার পেতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাঁদের। এ অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বেশি হওয়ায় গৃহহীন মানুষের কষ্ট আরও বেড়েছে। কাহরামানমারাস শহরের বাসিন্দাদের দুর্ভোগের একই রকম দৃশ্য চোখে পড়ছে আনতাকিয়া ও সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে। ভূমিকম্পে তুরস্কের দশটি ও সিরিয়ার চারটি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আরও পড়ুন

তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে গতকালও বেশ কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তবে এলাকাবাসী বলছেন, যেভাবে উদ্ধারকাজ চলছে, তা যথেষ্ট নয়। এ নিয়ে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেন আনতাকিয়া শহরের বাসিন্দা মেলেক। তিনি বলেন, ‘কোথায় তাঁবু, কোথায় খাবার? আমরা ভূমিকম্পের পরও বেঁচে গেছি। কিন্তু আমরা হয়তো ঠান্ডায় ও খাবার না পেয়ে মারা যাব।’

উদ্ধারকাজে ধীরগতির চিত্র ধরা পড়েছে সিরিয়াতেও। দেশটির উত্তরাঞ্চলের শহর জানদারিস। সেখানকার উদ্ধারকর্মী ও বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। জানদারিস শহরের একটি ভবনে ৩২টি অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। এ ভবনের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বেঁচে গেছেন। তাঁরা বলেন, ভূমিকম্পের পর এখান থেকে কাউকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধারকাজের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি দরকার, সেগুলো না থাকায় কাজ ধীরে চলছে।

আরও পড়ুন

সিরিয়ার আলেপ্পোর সড়কে স্বজনদের জন্য দুই দিন অপেক্ষা করছেন ইউসেফ নামের একজন। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের পর ধসে যাওয়া ভবনে তাঁর মা–বাবার কথা তিনি শুনেছেন। তবে তাঁদের এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

রয়টার্সের সাংবাদিককে ইউসেফ বলেন, ‘আমি উদ্ধারকারীদের বলেছি, স্বজনদের গলা আমি শুনতে পেয়েছি। কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্ছেন, উদ্ধারকাজ ধীরগতিতে চলছে। তাঁদের (উদ্ধারকর্মী) কাছে যথেষ্টসংখ্যক যন্ত্রপাতি নেই।’

আরও পড়ুন

জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা কমছে

ভূমিকম্পের তিন দিন পেরিয়ে যাওয়ায় তুরস্ক ও সিরিয়ার ধসে যাওয়া ভবনগুলো থেকে জীবিত মানুষদের উদ্ধারের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকাজের জন্য ৭২ ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ইলান কেলমান বলেন, ভূমিকম্পের পর যাঁদের জীবিত উদ্ধার করা হয়, তাঁদের মধ্যে ৯০ শতাংশ উদ্ধার হন তিন দিনের মধ্যে।

তবে এটাও নির্ভর করে ঘটনাস্থলের আবহাওয়া, কড়াঘাত ও উদ্ধারকারী দলের কাজের গতির ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দিক বিবেচনায় তুরস্ক ও সিরিয়া পিছিয়ে আছে। দেশ দুটিতে যেমন পর্যাপ্ত উদ্ধারকর্মী নেই, তেমনি যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। আবার আবহাওয়াও বৈরী।

লাশের সারি

যেসব মরদেহ উদ্ধার করা হচ্ছে, সেগুলো স্থানীয় হাসপাতালের বাইরে খেলার মাঠে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। কাহরামানমারাস শহরে একটি স্পোর্টস হলের মেঝেতে এমন ৫০টি লাশ দেখেছেন রয়টার্সের সাংবাদিক।

আনতাকিয়া শহরের হাতায় রিসার্চ হাসপাতালের পার্কিংয়েও এমন দৃশ্য দেখা গেছে। সেখানে দুই স্বজনের লাশের খোঁজে এসেছিলেন নাদা ও তাঁর স্বামী। নাদা সিরিয়ার নাগরিক। আর তাঁর স্বামী তুরস্কের। সেখানে ১০০টির বেশি লাশ রাখা হয়েছিল।

নাদার স্বামী বলেন, তাঁর স্ত্রী তুরস্কের ভাষায় কথা বলতে পারেন না। ফলে অনেকেই কথা বুঝতে পারছেন না। আর তিনি (স্বামী) ঠিকঠাক চোখে দেখেন না। ফলে লাশ খোঁজা তাঁদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।

সিরিয়ার আলেপ্পোয় আল–রাজি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন একজন। তিনি জানান, তাঁর পরিবারের ১৬ সদস্যের ১৩ জনই মারা গেছেন।

আরও পড়ুন