শুধু কি দ্রুজদের রক্ষায় সিরিয়ায় হামলা করছে ইসরায়েল
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত বুধবার বিকেলে তাঁর দেশের দ্রুজ সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে এক ভিডিও বার্তা দেন। সেখানে অনুরোধ করেন, তাঁরা যেন সুয়েইদায় স্থানীয় বেদুইন ও সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে দ্রুজ মিলিশিয়াদের লড়াইয়ে অংশ নিতে সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ না করেন।
কিন্তু নেতানিয়াহু যখন এ বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর নিজের বাহিনী সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে বোমাবর্ষণ করছিল, হামলা চালাচ্ছিল দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। আর এ হামলায় অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন।
নেতানিয়াহুর দাবি, দ্রুজদের রক্ষায় ইসরায়েল সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে।
২০১৮ সালের জাতিরাষ্ট্র আইনের প্রধান রূপকার বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এ আইন ইসরায়েলে দ্রুজসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করে।
সিরিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদের পতনের পর গত ডিসেম্বরে দেশটিতে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইসরায়েল সীমান্তের কাছে সিরীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলের বারংবার হুমকি তাদের এ প্রচেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমার ভাইয়েরা, ইসরায়েলের দ্রুজ নাগরিকেরা, সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সুয়েইদার পরিস্থিতি খুবই গুরুতর।’ তিনি সিরিয়া সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করে দ্রুজদের আশ্বস্ত করেন, ‘আমরা আমাদের দ্রুজ ভাইদের রক্ষায় এবং সিরিয়ার শাসক দলগুলো নির্মূলে কাজ করছি।’
ইসরায়েলের দ্রুজ সংখ্যালঘু গোষ্ঠী
সুয়েইদায় দ্রুজ ও স্থানীয় বেদুইনদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বহুদিন ধরে চলছে।
সিরিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদের পতনের পর গত ডিসেম্বরে দেশটিতে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইসরায়েলি সীমান্তের কাছে সিরীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলের বারংবার হুমকি তাদের এ প্রচেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিরিয়ায় দ্রুজ সম্প্রদায়ের আনুমানিক সাত লাখ মানুষের বসবাস। অন্যদিকে, ইসরায়েলে তাঁদের সংখ্যা দেড় লাখ। ইসরায়েলি দ্রুজদের অনেকেই মনে করেন, ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের সময় ১৯৪৮ সাল থেকে তাঁদের সঙ্গে ইহুদিদের একধরনের ‘রক্তের বন্ধন’ তৈরি হয়েছে। তবে ২০১৮ সালের জাতিরাষ্ট্র আইনের পর এ ভাবনায় ছেদ পড়েছে। এখন অনেক দ্রুজ মনে করেন, তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তবে এখনো বেশির ভাগ দ্রুজ ইসরায়েলি রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত ও সেনাবাহিনীতেও নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন।
ইসরায়েলের শীর্ষ বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক এই হামলাগুলো সম্ভবত পুরোপুরি দ্রুজদের রক্ষার উদ্দেশ্যে নয়; বরং এর পেছনে ইসরায়েলি সরকার ও সংকটে থাকা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই বেশি রয়েছে।
কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং দ্রুজ স্টাডিজ জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক রামি জিদান বলেন, ইসরায়েলি দ্রুজরা নিজেদের একই সঙ্গে দ্রুজ, ইসরায়েলি ও আরব বলে মনে করেন। তাঁরা মনে করেন, ইহুদি ও দ্রুজ—উভয়ই সংখ্যালঘু হিসেবে নিপীড়নের শিকার। এ ঐতিহাসিক উপলব্ধি তাঁদের ইসরায়েলের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তি তৈরি করেছে।
রামি জিদানের মতে, এখন এ সম্পর্কের ভিত্তিতেই ইসরায়েলি দ্রুজরা চাইছেন, ইসরায়েল যেন সিরিয়ায় তাঁদের সম্প্রদায়ের লোকজনকে রক্ষা করে। যদিও সিরীয় দ্রুজরা ঐতিহ্যগতভাবে ইসরায়েলবিরোধী। কিন্তু তাঁদের কিছু নেতা সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছেন।
‘পুরোপুরি সুযোগসন্ধানী’
বাস্তবতা হলো, সুয়েইদায় দ্রুজদের কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সহিংসতা শুরুর বহু আগে থেকেই ইসরায়েল সিরিয়ায় হামলা করে আসছে।
১৪ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পতনের পর থেকে ইসরায়েল সিরিয়ায় শত শত বার হামলা চালিয়েছে ও প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটার (১৫৫ বর্গমাইল) এলাকা দখলে নিয়েছে। এ ছাড়া ১৯৬৭ সাল থেকে সিরিয়ার পশ্চিম গোলান মালভূমি নিয়ন্ত্রণ করছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের শীর্ষ বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক এ হামলাগুলো সম্ভবত পুরোপুরি দ্রুজদের রক্ষার উদ্দেশ্যে নয়; বরং এর পেছনে ইসরায়েলি সরকার ও সংকটে থাকা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই বেশি রয়েছে।
নিউইয়র্কে ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কনসাল জেনারেল আলোন পিনকাস আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এটি পুরোপুরি সুযোগসন্ধানী বিষয়।’ আরেকটি আঞ্চলিক জাতিগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসরায়েল কখনো কুর্দদের সাহায্য করেনি। তাই দ্রুজদের ক্ষেত্রে সহানুভূতির ভাব দেখানোটা মূলত ছলচাতুরী।
পিনকাস সিরিয়ায় ইসরায়েলি সাম্প্রতিক হামলার পেছনে কয়েকটি উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন, যেমন নেতানিয়াহু যুদ্ধকালীন নেতা হিসেবে নতুন করে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চাচ্ছেন। এর মাধ্যমে নিজের দুর্নীতির মামলার বিচার বিলম্বিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি গত ২১ মাসে শুধু সামরিক শক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্গঠনের ‘ভ্রান্ত ধারণাকে’ জোরদার করার চেষ্টা করছেন।
পিনকাস আরও বলেন, ‘নেতানিয়াহু চান না, সিরিয়ায় একটা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে উঠুক; বরং তিনি চান, একটি দুর্বল রাষ্ট্র; যার এক অংশ কুর্দদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, অন্য অংশ দ্রুজ ও বেদুইনদের দখলে থাকবে। ফলে ইসরায়েল দক্ষিণ সিরিয়ায় নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে পারবে।’
‘যুদ্ধ সবকিছু শুষে নিয়েছে’
গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের আক্রমণের পর থেকেই ইসরায়েল চরম সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বহু কেলেঙ্কারির মুখে আছে নেতানিয়াহু সরকার। এর মধ্যে সিরিয়ায় হামলা এ সংকটকে জিইয়ে রাখতে সহায়তা করবে।
গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল লেবানন, ইরান, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে আসছে।
সিরিয়ায় সাম্প্রতিক হামলা নিয়ে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘মানুষ যুদ্ধের কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এমন নয়; বরং তারা আর গুরুত্ব দিচ্ছে না। এটা একধরনের উদাসীনতা।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধ মানুষকে সাময়িক অর্থ ও উত্তেজনা দেয়, কিন্তু তা বেশিক্ষণ থাকে না। এমনকি মানুষ ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে কী হয়েছিল, তা-ও ভুলে গেছে।’
গোল্ডবার্গ আরও বলেন, ‘এখন যুদ্ধ শুরু করতে আর কোনো সতর্কতা বা আলোচনা লাগে না। নতুন নতুন বিপদের নাম করে বারবার নতুন জায়গায় লড়াই শুরু হচ্ছে।’ পরিশেষে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলিরা আসলে দ্রুজদের নিয়ে ভাবেনই না। এটা শুধু আরেকটা নতুন হুমকি, নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। আর মানুষ এখন এমন মানসিকতায় পৌঁছেছে যে ‘‘ঠিক আছে, যা হচ্ছে হোক।’’ যুদ্ধ আমাদের সবকিছু শুষে নিয়েছে।’