গাজা নিয়ে ট্রাম্পের নতুন প্রস্তাব কি ইসরায়েলের গণহত্যা থামাবে, কী আছে প্রস্তাবে

হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে ‘শেষ সতর্কবার্তা’ দেওয়ার পর গাজায় নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য চাপ দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি। তবে ইঙ্গিত দিয়েছেন, গাজায় ইতিমধ্যে যে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে, তা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে; যদি হামাস তাঁর নতুন প্রস্তাব মেনে না নেয়। এ উপত্যকায় ইসরায়েল এখন পর্যন্ত ৬৪ হাজার ৫০০–এর বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে এবং সেখানে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় মাসের পর মাস ধরে যুদ্ধবিরতির আলোচনা চলছে। কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার তা প্রত্যাখ্যান করেছেন কিংবা কোনো জবাব দেননি।

সম্প্রতি হামাস ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর আগের একটি প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। প্রস্তাবে গাজা থাকা কিছু ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু পরে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে যায়। নেতানিয়াহু তখন শর্ত দেন, সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে এবং হামাসকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে হবে। এখন ট্রাম্প দাবি করছেন, তাঁর নতুন প্রস্তাব ভিন্ন ও ইতিবাচক ফল দিতে পারে।

গত রোববার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা একটা ভালো সমাধানের চেষ্টা করছি...খুব শিগগির তা শুনবেন। আমরা যুদ্ধ শেষ করতে চাই, জিম্মিদের ফেরত আনতে চাই।’

এখন দেখা যাক, ট্রাম্পের এ প্রস্তাবে কী আছে, আর তা আদৌ ইসরায়েলের গাজায় গণহত্যা থামাতে পারবে কি না।

ট্রাম্পের বর্তমান প্রস্তাবে শুরু থেকেই সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এর বিনিময়ে অজ্ঞাতসংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দীকে ছেড়ে দেবে ইসরায়েল। তারপর শুধু আলোচনা চলবে, কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ হবে না।

প্রস্তাবে কী আছে

চুক্তি নিয়ে খুব কম তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তবে ইসরায়েলি গণমাধ্যম বলছে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের আগের পরিকল্পনার মতো, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে।

উইটকফের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ইসরায়েলি জিম্মিদের অর্ধেক মুক্তি দেওয়া হবে। এরপর ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি চলবে এবং স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধে আলোচনা শুরু হবে। ইসরায়েল তখন প্রস্তাব মানলেও পরে হামাস সম্মতি দিলে নেতানিয়াহু শর্ত বদলান। তিনি বলেন, আংশিক চুক্তি চলবে না, সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে এবং হামাসকে ধ্বংস করতে হবে।

ট্রাম্পের বর্তমান প্রস্তাবে শুরু থেকেই সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এর বিনিময়ে অজ্ঞাতসংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দীকে ছেড়ে দেবে ইসরায়েল। তারপর শুধু আলোচনা চলবে, কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ হবে না।

ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ বলছে, এটি মূলত উইটকফের পরিকল্পনার নতুন সংস্করণ—জিম্মি ও বন্দিবিনিময়ের পর যুদ্ধ শেষ করতে আলোচনায় বসা।

মূল পার্থক্য হলো সব ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তির পরও যুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে থামবে না। এতে দেশটির হামলা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থেকে যাবে। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য, হামাসকে পুরোপুরি ধ্বংস করা। এ লক্ষ্য পরিমাপ করা কঠিন এবং ফিলিস্তিনিরা মনে করেন, এর আড়ালে আসলে পুরো গাজাকেই ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে।

আমরা একটা ভালো সমাধানের চেষ্টা করছি...খুব শিগগির তা শুনবেন। আমরা যুদ্ধ শেষ করতে চাই, জিম্মিদের ফেরত আনতে চাই।
ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট

হামাসের প্রতিক্রিয়া কী

হামাস জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব পেয়েছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘আমাদের জনগণের ওপর আগ্রাসন বন্ধে সহায়তা করবে, এমন যেকোনো উদ্যোগ আমরা স্বাগত জানাই।’

হামাস আগেও তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে—গাজায় আটক ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে, তবে বিনিময়ে নিশ্চিত করতে হবে যে ইসরায়েল হামলা বন্ধ করবে ও গাজা থেকে সেনা সরাবে।

গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালে ৭ সেপ্টেম্বর রাতে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনি শিশুদের মরদেহ দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন শোকাহত মানুষজন
ছবি: রয়টার্স

সংবাদমাধ্যম ড্রপ সাইট নিউজের হাতে পাওয়া হামাসের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। এর মধ্যে থাকবে সব বন্দী মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধ বন্ধের পরিষ্কার ঘোষণা, গাজা থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার ও স্বাধীন ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের দিয়ে গাজা পরিচালনা কমিটি গঠনের বিষয়।’

হামাস নেতা বাসেম নাঈম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে লিখেছেন, ‘স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, (নতুন প্রস্তাবের) প্রাথমিক লক্ষ্য হলো, প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করানো, কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো নয়, যা যুদ্ধ বন্ধে সহায়তা করবে।’

আরও পড়ুন

ইসরায়েলের অবস্থান

গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিওন সার বলেন, তাঁরা প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। তাঁর দাবি, ইসরায়েল যুদ্ধ থামাতে রাজি; যদি সব জিম্মি মুক্তি দেওয়া হয় এবং হামাস অস্ত্র সমর্পণ করে।

কিন্তু হামাস আগেই জানিয়েছে, তারা শুধু অস্ত্র ত্যাগ করবে যদি ইসরায়েল গাজা থেকে সরে যায় এবং পশ্চিম তীর ও গাজা মিলিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে সম্মত হয়, যার রাজধানী হবে দেশটির দখল করা পূর্ব জেরুজালেম।

যদিও ইসরায়েল প্রকাশ্যে ট্রাম্পের প্রস্তাব সমর্থন করছে, বিশ্লেষকদের ধারণা, পরে তারা আবার দাবি করবে যে তারা রাজি ছিল, কিন্তু হামাস না করেছে। আগেও নেতানিয়াহু এমন কৌশল নিয়েছেন—প্রথমে সম্মতি দিয়ে পরে অগ্রহণযোগ্য শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, যাতে যুদ্ধ চালানো যায়।

গতকাল ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুঁশিয়ারি দেন, ‘একটি প্রবল ঝড়’ গাজায় আঘাত হানবে এবং হামাস ধ্বংস হবে। তাঁর এ হুঁশিয়ারির সঙ্গে সঙ্গে গাজা সিটির সুউচ্চ ভবনগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। নেতানিয়াহুও গাজা সিটির বাসিন্দাদের সতর্ক করে বলেছেন, শহরটিতে স্থল অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে।

এদিকে ইসরায়েলি নেতারা গাজাকে নিয়ে হুমকি দিয়েই যাচ্ছেন।

গতকাল ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ হুঁশিয়ারি দেন, ‘একটি প্রবল ঝড়’ গাজায় আঘাত হানবে এবং হামাস ধ্বংস হবে। তাঁর এ হুঁশিয়ারির সঙ্গে সঙ্গে গাজা সিটির সুউচ্চ ভবনগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সেই দিনই নেতানিয়াহু গাজা সিটির বাসিন্দাদের সতর্ক করে বলেন, ‘এখান থেকে বেরিয়ে যাও।’ তিনি জানান, শহরটিতে স্থল অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

প্রস্তাব কি কার্যকর হবে

ট্রাম্প আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাইকে (জিম্মিদের) ফেরত আনব।’ গত ২৫ আগস্টও তিনি বলেছিলেন, তিন সপ্তাহের মধ্যেই যুদ্ধের ‘চূড়ান্ত সমাপ্তি’ হবে।

তবে বিশ্লেষকেরা সন্দিহান। আগের মতোই এবারও প্রস্তাব ব্যর্থ হতে পারে, মূলত নেতানিয়াহুর যুদ্ধ বন্ধে অনীহার কারণে।

স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, (নতুন প্রস্তাবের) প্রাথমিক লক্ষ্য হলো, প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করানো, কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো নয়, যা যুদ্ধ বন্ধে সহায়তা করবে।
বাসেম নাঈম, হামাস নেতা

হারেৎজে হাইম লেভিনসন লিখেছেন, এটি কিছুতেই কার্যকর হবে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর যুদ্ধ শেষ করার কোনো ইচ্ছাই নেই; বরং তিনি চাইছেন হামাসকে একগুঁয়ে প্রমাণ করে যুদ্ধ আরও মাসের পর মাস চালাতে।

ট্রাম্পও নেতানিয়াহুকে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাননি। গত মে মাসে উইটকফ কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতাকারীদের জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘ইসরায়েলকে যুদ্ধ থামাতে বাধ্য করবে না’।

আরও পড়ুন

ট্রাম্পকে কি বিশ্বাস করা যায়

ট্রাম্প বলছেন, হামাস যদি সব জিম্মিকে ছেড়ে দেয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা এগিয়ে নেবে। তবে আগেও তিনি এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাঁর দলের সহায়তায় সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময় যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়েছিল ১৯ জানুয়ারি।

কিন্তু দুই মাস পরই নেতানিয়াহু একতরফাভাবে চুক্তি ভেঙে যুদ্ধ চালিয়ে যান। সমালোচকেরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র শক্তভাবে চাপ না দিলে নেতানিয়াহু কোনো যুদ্ধবিরতি মানবেন না।

গাজা সিটিতে ৭ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি বিমান হামলায় একটি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর আহত শিশুকে কোলে নিয়ে যাচ্ছেন এক ফিলিস্তিনি
ছবি: রয়টার্স

কাতারের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স-এর বিশেষজ্ঞ ওমর রহমান আল–জাজিরাকে বলেন, এ মুহূর্তে নেতানিয়াহু কিংবা ট্রাম্প—দুজনের কাউকেই বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। বিশেষত যখন তাঁরা প্রকাশ্যে গাজাকে জাতিগতভাবে নিমূল করে মার্কিন রিয়েল এস্টেট প্রকল্পে পরিণত করার পরিকল্পনা করছেন।

ট্রাম্প আগেও প্রস্তাব করেছিলেন, গাজার জনগণকে উচ্ছেদ করে সেখানে ‘গাজা রিভিয়েরা’ (সমুদ্রতীরের অবকাশকেন্দ্র) বানানো হবে। সমালোচকেরা একে জাতিগত নিধন বলে নিন্দা করেছেন। যদিও তিনি এখন বিষয়টি কমই উল্লেখ করেন, তবে তাঁর প্রশাসন মাঝেমধ্যে আবার বিষয়টি তোলে।

আরও পড়ুন

এরপর কী

অদূর ভবিষ্যতেও গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

ট্রাম্প যখন হামাসকে হুমকি দিচ্ছেন, তখন গাজার চিকিৎসকেরা সীমিত সরঞ্জামে রোগী সামলাচ্ছেন। বেঁচে যাওয়া মানুষ বলছেন, গাজার কিছু অংশে বসবাস করা মানে ‘নরকের ভেতরে থাকা’। গাজায় আরও শিশু অনাহারে মারা যেতে থাকবে। আর ইসরায়েলি বাহিনীও অবশিষ্ট অবকাঠামোগুলোতে হামলা চালিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন