দক্ষিণ সিরিয়ায় সংঘাতে ৯৪০ জন নিহত
সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে সুয়েইদা প্রদেশে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর দেশটির সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ইসরায়েল। গতকাল শুক্রবার তুরস্কে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত টম বারাক এ তথ্য জানিয়েছেন। যুদ্ধবিরতি শুরুর ঘোষণা দিয়েছে সিরিয়া সরকারও। প্রায় এক সপ্তাহ চলা এই সংঘাতে দেশটিতে নিহত হয়েছেন নারী-শিশুসহ ৯৪০ জন।
সম্প্রতি সুয়েইদায় সংঘাত শুরু হয়েছিল দ্রুজ ও বেদুইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ১৩ জুলাই এই সংঘাত থামাতে হস্তক্ষেপ করে সিরীয় বাহিনী। তবে দ্রুজ যোদ্ধাদের সঙ্গেই উল্টো সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুজদের রক্ষার কথা বলে ১৬ জুলাই দামেস্কে হামলা চালায় ইসরায়েল। এরপর দ্রুজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে সুয়েইদা ত্যাগ করেন সিরীয় সেনারা।
শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করে ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতির কথা জানান টম বারাক। এই যুদ্ধবিরতিতে সমর্থন দিয়েছে তুরস্ক, জর্ডান ও প্রতিবেশী দেশগুলো। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা দ্রুজ, বেদুইন ও সুন্নিদের অস্ত্র পরিত্যাগের এবং অন্য সংখ্যালঘুদের সঙ্গে মিলে সিরিয়ার নতুন এবং ঐক্যবদ্ধ পরিচয় গঠনের আহ্বান জানাচ্ছি।’
‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে’ রাজি হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। তিনি বলেন, ‘আমরা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা কাটিয়ে উঠতে এই মুহূর্তে বিভিন্ন শাখার মধ্যে ঐক্য ও পূর্ণ সহযোগিতার প্রয়োজন।’ এর আগে গত বৃহস্পতিবার অভিযোগ করে তিনি বলেছিলেন, সিরিয়াকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে ইসরায়েল।
দ্রুজ একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী। সিরিয়া ছাড়াও ইসরায়েল ও লেবাননেও তাদের বসবাস রয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, দ্রুজদের ওপর ব্যাপক হারে সহিংসতা চলছে। এই সহিসংতা থামানোর কথা বলেই ১৬ জুলাই দামেস্কে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের কাছে ব্যাপক হামলা চালায় ইসরায়েল। শুক্রবার দিনের শুরুতেও সুয়েইদায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি দূতাবাস থেকে এখনো কিছু জানানো হয়নি। তবে শুক্রবার সংঘাত থামাতে সুয়েইদায় ৪৮ ঘণ্টার জন্য সীমিত পরিসরে সিরীয় সেনা মোতায়েনের অনুমতি দিয়েছিল ইসরায়েল। পরে সুয়েইদায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে এবং আরও সংঘাত এড়াতে প্রদেশটিতে আবার সেনা মোতায়েনের কথা জানায় সিরিয়া সরকার।
সংঘাতে নিহত ৯৪০
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি অব হিউম্যান রাইটসের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই সুয়েইদায় সেনা মোতায়েনের পর থেকে সেখানে ৯৪০ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩২৬ জন দ্রুজ যোদ্ধা, ২৬২ জন দ্রুজ বেসামরিক লোকজন, ৩১২ জন সিরীয় সেনা, ২১ জন বেদুইন গোষ্ঠীর সদস্য রয়েছেন। আর সিরিয়া সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সহিংসতায় আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক।
এদিকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরও শুক্রবার হাজার হাজার বেদুইন যোদ্ধা সুয়েইদায় প্রবেশ করছিলেন বলে জানিয়েছেন রয়টার্সের সাংবাদিকেরা। এতে স্থানীয়দের মধ্যে নতুন করে সংঘাত শুরুর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সংঘাতের কারণে তাঁদের কাছে খুব কম খাবার ও পানি অবশিষ্ট আছে। কয়েক দিন ধরে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ।
সুয়েইদার ২৮ বছর বয়সী বাসিন্দা মুদার রয়টার্সকে বলেন, ‘চার দিন ধরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, খাবার, পানি—কিছুই নেই। সংঘাত এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। আমরা সহজে কোনো খবর পাচ্ছি না। কারণ, ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।’ সুয়েইদার উত্তর ও পশ্চিমে এখনো সংঘাত চলছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সুয়েইদা-২৪-এর প্রধান রায়ান মারুফ।
সুয়েইদায় যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তাতে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনতে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান ফলকার টুর্ক। সম্প্রতি তিনি বলেন, সুয়েইদায় নির্বিচার হত্যাসহ মানবাধিকারের বিস্তৃতি লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তাঁদের হাতে রয়েছে। হামলাকারীদের মধ্যে সেনাসদস্য ছাড়াও দ্রুজ ও বেদুইন যোদ্ধারা রয়েছেন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের অভিযানের মুখে পতন হয় বাশার আল-আসাদ সরকারের। এই অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আহমেদ আল-শারা। পরে তিনি দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। সিরিয়ার বর্তমান সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়িয়েছে আল-শারা সরকার। তবে বরাবরই আল-শারাকে একজন ‘জিহাদি’ তকমা দিয়ে এসেছে ইসরায়েল। এমনকি বাশার আল-আসাদের পতনের পর থেকে সিরিয়ায় হামলা বাড়িয়েছে তারা।