গাজায় যুদ্ধবিরতি নেতানিয়াহুর জন্য ডেকে এনেছে ৬টি বড় বিপদ

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুফাইল ছবি: রয়টার্স

গাজায় ইসরায়েলের হামলায় গত দুই বছরে অগণিত প্রাণহানি ও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। তবু দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য এ উপত্যকায় শান্তি যেন অকালেই এসেছে। এমনটাই মনে হচ্ছে কিছু পর্যবেক্ষকের চোখে।

সমালোচকেরা বলছেন, এ যুদ্ধকে নেতানিয়াহু নিজ রাজনৈতিক অবস্থান ও এমনকি তাঁর স্বাধীনতার (বিভিন্ন মামলা থেকে মুক্তি) চ্যালেঞ্জগুলো থেকে মনোযোগ সরানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, এসব সমস্যার একটিও মুছে যায়নি।

যুদ্ধবিরতিকে নেতানিয়াহু বিজয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আলন পিনকাসসহ অনেকের মতে, এ যুদ্ধবিরতি ছিল মূলত সাজানো নাটক; যা হোয়াইট হাউসের চাপে নেতানিয়াহু মানতে রাজি হয়েছেন। কারণ, ওয়াশিংটন গাজা যুদ্ধের আর্থিক ও কূটনৈতিক বোঝা বইতে আর রাজি ছিল না।

তাহলে প্রশ্ন উঠছে, যদি নেতানিয়াহু নতুন কোনো যুদ্ধ শুরু করতে না পারেন, তবে আগামী বছরের ইসরায়েলি নির্বাচনের আগে–পরে নেতানিয়াহুর সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে? আর সেগুলো কতটা ভয়ানক হতে পারে?

চলুন, একে একে দেখে নেওয়া যাক।

১. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতানিয়াহু কি আরও একা হয়ে পড়বেন

বর্তমানে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যতটা নিঃসঙ্গ, অতীতে কখনো এতটা ছিল না। আর অনেকের কাছেই সেই নিঃসঙ্গতার প্রতীক এখন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

গত দুই বছরে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। খাদ্য অবরোধে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ দৃশ্য বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। স্বল্প মেয়াদে, যদি না নেতানিয়াহু সরকার আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের স্থায়ীভাবে গাজায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে বিশ্বের গণমাধ্যমে এ হত্যাযজ্ঞের চিত্র আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাবে। এটি ইসরায়েলের একঘরে অবস্থানকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করবে।

যুদ্ধবিরতিকে নেতানিয়াহু বিজয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আলন পিনকাসসহ অনেকের মতে, এ যুদ্ধবিরতি ছিল মূলত সাজানো নাটক; যা হোয়াইট হাউসের চাপে নেতানিয়াহু মানতে রাজি হয়েছেন। কারণ, ওয়াশিংটন গাজা যুদ্ধের আর্থিক ও কূটনৈতিক বোঝা বইতে আর রাজি ছিল না।

তবে ইসরায়েলের জন্য ক্রমবর্ধমাণ এ কূটনৈতিক নিঃসঙ্গতা নতুন নয়। গত সেপ্টেম্বরেই নেতানিয়াহু যেন এ অবস্থাকে স্থায়ী করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন একটি ‘সুপার স্পার্টা’ তৈরির স্বপ্ন। সেটি প্রাচীন যুদ্ধবাজ গ্রিক নগররাষ্ট্র স্পার্টার আদলে এমন এক রাষ্ট্র, যা অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন, কূটনৈতিকভাবে আলাদা এবং যুদ্ধকেই জীবনধারা হিসেবে গ্রহণ করবে।

এ বক্তব্য ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীরা ভালোভাবে নেননি। ঘোষণার পরই তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক ধসে পড়ে এবং শেকেলের মান অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় কমে যায়। দেশের ২০০ বড় প্রতিষ্ঠানের সংগঠন ‘ইসরায়েল বিজনেস ফোরাম’ এক বাক্যে বলেছিল, ‘আমরা স্পার্টা নই।’

জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে বক্তৃতা দিচ্ছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালে অধিবেশনকক্ষ ছেড়ে যান অনেক দেশের প্রতিনিধি। এ সময় চারপাশে খালি আসন পড়ে থাকতে দেখা যায়। নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছবি: রয়টার্স

২. দক্ষিণপন্থীরা কি নেতানিয়াহুর জোট সরকার ভেঙে দিতে পারেন

এটি সম্ভব। তবে নেতানিয়াহু ইতিমধ্যে সেই ঝুঁকি এড়াতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। যুদ্ধ চলাকালে ও এর আগে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্কের সময়েও চরম দক্ষিণপন্থীদের ওপর নির্ভর করেছেন তিনি।

সবচেয়ে দৃশ্যমানভাবে, অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির— দুজনই যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করলেও এখনো নেতানিয়াহুর জোটে আছেন।

আইসিসি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, তাঁর সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। আইসিজেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া জাতিহত্যার মামলা শুনছেন। যদি আইসিজে ইসরায়েলকে দোষী সাব্যস্ত করেন, তবে অনেকেই সে জন্য সরাসরি নেতানিয়াহুকেই দায়ী করবেন।

এ দুজনের বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় নেতানিয়াহু এখন একটি আইন আনতে যাচ্ছেন; যাতে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (ইয়েশিভা) শিক্ষার্থীদের সামরিক নিয়োগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এতে তিনি আশা করছেন, আলট্রা-অর্থডক্স দলগুলো আবার তাঁর জোটে ফিরবে। ফলে কোনো দল যদি সরে যায়, তবু সরকার টিকে থাকবে।

৩. আইসিসি ও আইসিজে কি নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন

হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলকে গাজায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করতে পারেন।

২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে আইসিসি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, তাঁর সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। দেইফকে পরবর্তী সময়ে ইসরায়েল হত্যা করে।

অন্যদিকে, আইসিজেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া জাতিহত্যার মামলা শুনছেন। যদি আদালত ইসরায়েলকে দোষী সাব্যস্ত করেন, তবে অনেকেই সে জন্য সরাসরি নেতানিয়াহুকেই দায়ী করবেন।

গ্যালান্ট ও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির মামলার কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই। আইসিজের রায়ও ২০২৭ সালের আগে আসার সম্ভাবনা কম। আইসিসি যদি দোষী সাব্যস্ত করেন, তবে সর্বোচ্চ ৩০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। আর আইসিজে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিলে বিষয়টি সাধারণত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে কার্যকর করতে পাঠানো হয়।

একেবারেই অননুমেয় মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্পর্কের ওপরই অনেক কিছু বাজি রেখেছেন নেতানিয়াহু
ছবি: রয়টার্স
আরও পড়ুন

৪. ট্রাম্প কি নেতানিয়াহুকে পরিত্যাগ করতে পারেন

এ সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রই ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় আর্থিক, সামরিক ও কূটনৈতিক ভরসা। ওয়াশিংটনের সমর্থন ছাড়া ইসরায়েল আর নেতানিয়াহু মারাত্মক বিপদে পড়বেন।

যতই নেতানিয়াহু দাবি করুন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনেরও সীমা আছে। ২০২১ সালে ট্রাম্প নাকি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ওই সময় নেতানিয়াহু প্রথম কয়েকজন বিশ্বনেতার একজন ছিলেন, যিনি জো বাইডেনকে নির্বাচনে জেতায় অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

এমনকি গত মে মাসে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন বলে জানা যায়। কারণ, তিনি মনে করেছিলেন, নেতানিয়াহু তাঁকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন।

সম্প্রতি দোহায় হামাসের আলোচকদের ওপর ইসরায়েলের বিমান হামলার পর ট্রাম্পের ক্ষোভ চরমে ওঠে। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘ওই লোকটা (নেতানিয়াহু) আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে!’

যুদ্ধবিরতির আগে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নেতানিয়াহুর সঙ্গে কঠিন কথা বলেছেন এবং বলেছেন, ‘আমি না বলা পর্যন্ত ইসরায়েল গাজায় আবার ঢুকবে না।’

পরে ইসরায়েলি পার্লামেন্টে যুদ্ধবিরতি উপলক্ষে দেওয়া বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেন, ‘এই যুদ্ধবিরতি ৩ হাজার বছর ধরে প্রস্তুত হচ্ছিল এবং এটা টিকেও থাকবে।’

এখন যদি নেতানিয়াহু সেই স্থিতাবস্থা নষ্ট করেন, ট্রাম্প যে ভালোভাবে নেবেন না, তা বলাই যায়।

আরও পড়ুন

৫. ৭ অক্টোবরের হামলার আগে নিরাপত্তা ব্যর্থতা নিয়ে কি তদন্ত হবে

এ সম্ভাবনা এখন ক্রমেই বাড়ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন। জিম্মি করা হয় প্রায় ২৫০ জনকে। এ ঘটনার তদন্তে দেখা গেছে, ইসরায়েলের সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে গুরুতর দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা ছিল। তারা এমন আক্রমণের কোনো পূর্বাভাসই ধরতে পারেনি।

পৃথক তদন্তের পর সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান—দুজনই পদত্যাগ করেন।

নেতানিয়াহু অন্যান্য তদন্তে কোনো আপত্তি জানাননি, তবে নিজ সরকারের ভূমিকা নিয়ে হওয়া তদন্তের তিনি বিরোধ করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হবে এবং যুদ্ধ চলাকালীন এটা করা সম্ভব নয়।

কিন্তু যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত সর্বসম্মতভাবে রায় দেন যে, তদন্ত বিলম্বের কোনো যৌক্তিক কারণ আর নেই। আদালত সরকারকে ৩০ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলেছে।

একই অভিযোগে অভিযুক্ত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট। দুজনের বিরুদ্ধেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে
ছবি: এএফপি
আরও পড়ুন

৬. নেতানিয়াহুর কি জেলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে

হ্যাঁ, তা রয়ে গেছে। গত সোমবার ট্রাম্প নিজেই গাজার যুদ্ধ ও নেতানিয়াহুর দুর্নীতি মামলার যোগসূত্রের ইঙ্গিত দিয়েছেন।

ইসরায়েলের পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প দেশটির প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগকে নেতানিয়াহুকে ক্ষমা করে দেওয়ার আহ্বান জানান। মজা করে বলেন, ‘সিগার আর শ্যম্পেন নিয়ে কি কারও মাথাব্যথা আছে?’

তবে বাস্তবে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি দুর্নীতি মামলা চলছে। যুদ্ধকালেও নানা বিলম্ব সত্ত্বেও মামলাগুলোর কার্যক্রম থেমে থাকেনি।

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ঘুষ, জালিয়াতি ও আস্থাভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে তাঁর ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

আরও পড়ুন