গাজায় জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল: জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন
গাজায় ২৩ মাসের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল। আজ মঙ্গলবার প্রকাশিত জাতিসংঘের এক স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘ যখন এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তখন গাজা নগরীতে ব্যাপক স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
২০২৩ সালের অক্টোবরে সংঘাত শুরুর প্রায় দুই বছর পর আজ জাতিসংঘের ওই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো। তদন্তটি করেছে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে জাতিসংঘের গঠন করা একটি আন্তর্জাতিক স্বাধীন কমিশন। এতে জাতিগত নিধনের জন্য ইসরায়েলে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দায়ী করা হয়েছে।
জাতিসংঘের এই তদন্ত কমিশনের প্রধান নাভি পিল্লাই। আজ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হেরজগ গাজায় হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ ও উসকানি দিয়েছিলেন বলে তদন্তে দেখা গেছে। তাঁরা যেহেতু ইসরায়েল রাষ্ট্রের কর্মকর্তা, তাই বলা যায় এই জাতিগত নিধন ইসরায়েলই চালিয়েছে।
তবে জাতিসংঘের এই তদন্ত প্রতিবেদনকে ‘ভুয়া’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে বলেছে, হামাসের ‘মিথ্যাচারের’ ওপর নির্ভর করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এই ‘বিকৃত ও মিথ্যা’ প্রতিবেদন ইসরায়েল প্রত্যাখ্যান করছে। একই সঙ্গে এ-সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিশন দ্রুত বিলুপ্ত করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনেই কেবল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় জাতিগত নিধন চালানোর অভিযোগ আনা হয়নি। এর আগে ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েল জাতিগত নিধন চালাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এ ছাড়া গত এপ্রিলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ এনেছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
এর আগে ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েল জাতিগত নিধন চালাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এ ছাড়া গত এপ্রিলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ এনেছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
তদন্ত প্রতিবেদনে যা আছে
জাতিসংঘের এই তদন্ত প্রতিবেদন মোট ৭২ পাতার। তাতে বলা হয়েছে, ১৯৪৮ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশনে’ পাঁচটি কর্মকাণ্ডকে জাতিগত নিধনমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। গাজায় ২৩ মাসের বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলের অভিযানের সময় তার মধ্যে চারটি কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর ভিত্তিতে বলা হয়েছে, গাজায় জাতিগত নিধন চলছে।
গাজায় চলমান সংঘাতের সময় ইসরায়েলের সংঘটিত ওই চারটি কর্মকাণ্ড হলো একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা; শারীরিক ও মানসিকভাবে তাদের গুরুতর ক্ষতিসাধন করা; ওই সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা এবং ওই সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্মে বাধা দেওয়া।
জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী, জাতিগত নিধনের আইনি সংজ্ঞা পূরণ করতে হলে এটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে কোনো সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কনভেনশনে উল্লেখ করা এক বা একাধিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সে ক্ষেত্রে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চারটি কর্মকাণ্ডের প্রমাণ মিলেছে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে ২০২১ সালে এই কমিশন গঠন করেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল গাজার ফিলিস্তিনিদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করেছে, তাঁদের গুরুতর ক্ষতিসাধন করেছে, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুপরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে এবং অবরোধের মাধ্যমে গাজাবাসীকে অনাহারে রেখেছে। এ থেকে যুক্তিসংগত উপসংহারেই পৌঁছানো যায় যে উপত্যকাটিতে জাতিগত নিধনের অভিপ্রায় নিয়ে এটি করেছে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ ও সামরিক বাহিনী।
গাজা নগরীতে স্থল অভিযান শুরু
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ইসরায়েল থেকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে আসা হয় প্রায় আড়াই শ জনকে। সেদিন থেকেই হামাস নিধনের কথা বলে উপত্যকাটিতে নির্বিচার হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। এতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ।
এই হত্যাযজ্ঞের মধ্যেই উপত্যকাটির উত্তরাংশে সবচেয়ে বড় শহর এলাকা গাজা নগরীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি দিয়ে আসছিল ইসরায়েলি বাহিনী। সে লক্ষ্যে গত মাসে এলাকাটির উপকণ্ঠে স্থল অভিযান শুরু করা হয়। সেখান থেকে বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যেতেও নির্দেশ দেয় ইসরায়েল। এরই মধ্যে আজ থেকে গাজা নগরীতে স্থল অভিযান শুরুর ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
গাজা নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তেল আল-হায়া এলাকার বাসিন্দারা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, জল, স্থল ও আকাশপথ-তিন দিক দিয়েই হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এমনকি বিস্ফোরকভর্তি রোবটও পাঠাচ্ছে তারা।
ইসরায়েলি বাহিনীর এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, আজ গাজা নগরীতে ঢুকতে শুরু করেছে তাঁদের স্থলবাহিনী। ইসরায়েলের বিশ্বাস, সেখানে তিন হাজারের মতো হামাস সদস্য রয়েছেন। তাঁদের মোকাবিলা করতে আগামী দিনগুলোতে সেখানে ইসরায়েলি সেনাসংখ্যা বাড়ানো হবে। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ দম্ভ ভরে লিখেছেন, ‘গাজা জ্বলছে।’
গাজা নগরীতে স্থল অভিযানের বিরোধিতা করে আসছিলেন ইসরায়েলের সেনাপ্রধান ইয়াল জমির। তাঁর মতে, এর জেরে গাজায় থাকা ৫০ জিম্মিকে ইসরায়েলের ফিরিয়ে আনা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন ইউরোপের নেতারা। তবে সোমবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে দেখা করে গাজা ইস্যুতে তাঁকে অবিচল সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। এরপরই নতুন স্থল অভিযান শুরু করা হলো।
দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বোমাবর্ষণ
গাজা নগরীর অভ্যন্তরে স্থল অভিযান শুরুর মধ্য দিয়ে সেখানে হামলা আরও জোরদার করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। প্রায় দুই বছরের মধ্যে সেখানে এত তীব্র বোমাবর্ষণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, আজ ভোর থেকে গাজাজুড়ে অন্তত ৭৮ জন ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন।
গাজা নগরীর বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে আকাশপথে হামলা চালানো হয়। নগরীর দিকে এগিয়ে আসে ইসরায়েলের ট্যাংকগুলো। মধ্যরাতের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয় একটি বহুতল ভবনে। এ সময় ওই ভবনের ধ্বংসস্তূপের ভেতরে আটকে থাকা ব্যক্তিদের উদ্ধারে তৎপরতা চালাতে দেখা যায়।
তীব্র হামলা চালানো হয়েছে গাজা নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তেল আল-হায়া এলাকায়। সেখানকার বাসিন্দারা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, জল, স্থল ও আকাশপথ—তিন দিক দিয়েই হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এমনকি বিস্ফোরকভর্তি রোবটও পাঠাচ্ছে তারা। সেগুলো এতটাই শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে যে ধ্বংস হওয়া বিভিন্ন জিনিসপত্র কয়েক শ মিটার দূরেও ছিটকে পড়ছে।
ইসরায়েলের এই হামলা ও হুমকির মুখে গাজা নগরী ছেড়ে পালাচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা। হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনীর হিসাবে, সেখান থেকে সাম্প্রতিক দিনগুলোয় সাড়ে তিন লাখের মতো ফিলিস্তিনি অন্যত্র চলে গেছেন। তবে ব্যতিক্রম একজন নগরীর উপকণ্ঠের সাবরা এলাকার বাসিন্দা উম মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘আমরা যে মৃত্যু থেকে পালিয়ে মৃত্যুর দিকেই যাচ্ছি।’
ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় খাবার, পানি, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ জরুরি বিভিন্ন সরঞ্জামের সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় অনাহারে আরও তিন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে চলমান সংঘাত শুরুর পর থেকে উপত্যকাটিতে অনাহারে অন্তত ৪২৮ জনের মৃত্যু হলো।