ছোট্ট নূরের শরীরজুড়ে ইসরায়েলি হামলার বীভৎসতা
ছয় বছরের শিশু নূর মোসাউয়ির পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে সে। সারা বাড়ি মাতিয়ে বেড়ানো মেয়েটি এখন যন্ত্রণায় কাতর। যুদ্ধ কী বোঝে না নূর। অস্ত্র কী তা–ও জানে না। তবু যুদ্ধের বীভৎসতা তাঁর ছোট্ট শরীরজুড়ে।
নূর থাকে লেবাননের পূর্বাঞ্চলীয় বেকা উপত্যকায়। কৃষি আর কৃষিভিত্তিক শিল্পে সমৃদ্ধ পাহাড়ি একটি এলাকা। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে পুরো উপত্যকা যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। মুহুর্মুহু ইসরায়েলি বিমান হামলায় রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে পুরো উপত্যকা।
গত সপ্তাহের শুরু থেকে লেবাননে হামলা জোরদার করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এক ঘণ্টায় ৩০টির বেশি বিমান হামলার ঘটনাও ঘটেছে। হামলায় বেকা উপত্যকায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৬ জন। নিহতের সংখ্যা আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
একের পর এক হামলায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন অনেকেই। তাদেরই একজন ছয় বছর বয়সের নূর মোসাউয়ি। স্থানীয় রায়াক হাসপাতালের শিশু বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি আছে সে। সঙ্গে রয়েছেন নূরের মা রিমা। মেয়ের পাশে বসে পবিত্র কোরআন পড়ছেন। মেয়ের জন্য দোয়া করছেন তিনি। রিমা বলেন, ‘মেয়েটা খুবই উজ্জ্বল ও মিশুক প্রকৃতির। বাড়িতে সব সময় মজা করে। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে। এখন মেয়েটা হাসপাতালে থাকায় বাড়িটা কেমন খালি খালি লাগছে।’
গত সোমবার ইসরায়েলি হামলার শিকার হয় নূর। রিমা বলেন, তিনি মেয়েকে অভয় দিয়েছিলেন। মেয়েও আল্লাহর সাহায্য চাইছিল।
বোমা হামলার সময় যমজ সন্তান নূর আর মোহাম্মদকে নিয়ে বাড়ির সদর দরজার কাছে ছিলেন রিমা। তিনি বলেন, ‘আমরা ভেতরে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, বোমা পড়লে ভবনটি আমাদের মাথার ওপর ধসে পড়বে। আমরা চাপা পড়ব।’
রিমা আরও বলেন, ‘কিন্তু যখন হামলা জোরালো হলো, আমি সন্তানদের নিয়ে দ্রুত ভেতরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্র তার চেয়েও দ্রুতগতিতে আঘাত হানে। মোহাম্মদ সামান্য আহত হলেও নূর জীবন সংশয়ে পড়ে যায়।’
নূরের বাবা আবদুল্লাহ বাড়ি ফিরে এ পরিস্থিতি দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বলেন, ‘আমার মেয়েটা অস্ত্র চিনত না। যুদ্ধ কী, সেটা বুঝত না। বোমা হামলা শুরুর সময় সে বাড়িতে খেলছিল।’
ইসরায়েলের দাবি, হিজবুল্লাহর স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে সংগঠনের অস্ত্রের মজুতাগার-গোলাবারুদ রাখার জায়গা রয়েছে।
আবদুল্লাহ বলেন, ‘অস্ত্র নিয়ে আমাদের কোনো কাজকারবার নেই। আমি হিজবুল্লাহর সঙ্গেও সম্পৃক্ত নই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি যদি আমার সন্তানদের রক্ষা করতে পারতাম।’
রায়াক হাসপাতালের মেডিকেল পরিচালক চিকিৎসক বাসিল আবদুল্লাহ জানান, সোমবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ৪০০ আহত মানুষ হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের সবাই বেসামরিক মানুষ। তিনি আরও বলেন, হামলায় নিহত হয়েছেন এক শর বেশি মানুষ। বেশ কিছু পরিবার একজনের অধিক স্বজন হারিয়েছে।
চিকিৎসক বাসিল বলেন, হামলার তীব্রতায় শুধু রোগীরা নন, চিকিৎসাকর্মীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘বোমার আঘাতে শিশুদের, প্রবীণ রোগীদের, নারীদের আহত হতে দেখা খুবই কঠিন।’
মুহুর্মুহু ইসরায়েলি বিমান হামলার কারণে হাসপাতালে ওষুধ ও প্রয়োজনীয় জিনিসের মজুত ক্রমেই কমে আসা নিয়েও উদ্বিগ্ন চিকিৎসক বাসিল। তিনি আশঙ্কা করছেন, বর্তমান পরিস্থিতি একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের পথে গড়াচ্ছে।