বাশার আল-আসাদ সরকার উৎখাতে ‘বিদ্রোহীদের অভিযান সম্পর্কে জানত তুরস্ক’

বাশার আল–আসাদ পালিয়ে যাওয়ায় সিরিয়ায় শুধু বাথ পার্টির শাসনেরই অবসান ঘটেনি, একই সঙ্গে ছায়া যুদ্ধে ইরান ও রাশিয়ারও পরাজয় ঘটেছেছবি : রয়টার্স

১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো দেশের ক্ষমতা থেকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের নিয়ন্ত্রণ আলগা করার সুযোগ দেখে মাস ছয়েক আগে। সে সময় তারা বড় ধরনের আক্রমণ চালানোর বিষয়ে তুরস্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং আঙ্কারা থেকে মৌন সম্মতি পায়। এই পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত দুটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

মাত্র দুই সপ্তাহ আগে শুরু করা বিদ্রোহীদের অভিযানে দ্রুতই সাফল্য আসে। সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখল করে নেয় তারা, যা প্রায় সবাইকে বিস্মিত করে। সেখান থেকে এক সপ্তাহের চেয়ে সামান্য কিছু বেশি সময়ের মধ্যে রোববার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো রাজধানী দামেস্কে পৌঁছে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের পাঁচ দশকের শাসনের ইতি ঘটিয়েছে।

বিস্ময়কর গতিতে এই এগিয়ে চলা মূলত বাশার আল–আসাদবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর জন্য সহায়ক কতগুলো বিষয় একসঙ্গে ঘটার কারণে সম্ভব হয়েছে। বাশার আল–আসাদের সেনাবাহিনী মানসিকভাবে চাঙা ছিল না এবং তারা অবসন্ন হয়ে উঠেছিল; তাঁর প্রধান দুই মিত্র ইরান ও হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের কারণে ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং তাঁর আরেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক মিত্র রাশিয়া মনোযোগ সরিয়ে এখানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল।

ওই অঞ্চলের একজন কূটনীতিক এবং সিরিয়ার বিদ্রোহীদের একজন সদস্য রয়টার্সকে বলেন, বিদ্রোহীদের জন্য তুরস্ককে না জানিয়ে সামনে এগোনোর উপায় ছিল না। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের শুরু থেকে বিদ্রোহীদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় রয়েছে তুরস্ক।

সিরিয়ার উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে তুরস্কের সেনা মোতায়েন রয়েছে। তা ছাড়া সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মিসহ (এসএনএ) কিছু বিদ্রোহীকে সহায়তা দিয়ে আসছে দেশটি। যদিও তারা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের জোটের প্রধান শরিক হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস)–কে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে।

মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলের ওই কূটনীতিক বলেন, বিদ্রোহীদের বাশার আল–আসাদ সরকার উৎখাতে চূড়ান্ত অভিযানের পরিকল্পনা মূলত এইচটিএস এবং এর নেতা আহমেদ আল শারার, যিনি আবু মোহাম্মদ আল–জোলানি নামেই বেশি পরিচিত।

আগে আল–কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে জোলানিকে আগেই সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছে ওয়াশিংটন, ইউরোপ ও তুরস্ক।

সমর্থকদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। ৮ ডিসেম্বর, সিরিয়ার দামেস্কের উমায়াদ মসজিদে
ছবি: রয়টার্স

অবশ্য গত দশকে এইচটিএস (আগে যারা নুসরা ফ্রন্ট নামে পরিচিত ছিল) নিজেদের মধ্যপন্থী সংগঠন হিসেবে ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করেছে। এ সময় তারা সিরিয়ার ইদলিব এলাকায় নিজেদের মতো করে প্রশাসন চালিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, সেখানে তারা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের ওপর কর আরোপ করেছে, সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও কর নিয়েছে।

সিরিয়ার উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে লড়াই কমাতে ২০২০ সালে রাশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সরকার। তারা দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহীদের বড় ধরনের আক্রমণের বিরোধিতা করেছে। কারণ, এ ধরনের আক্রমণ চালানো হলে তাতে তাদের সীমান্তে আবার শরণার্থীর ঢল নামতে পারে বলে আশঙ্কা করছিল দেশটি।

সূত্রগুলোর ভাষ্যমতে, অবশ্য এ বছরের প্রথম দিকে বাশার আল–আসাদ সরকার বিষয়ে আঙ্কারার অবস্থানে পরিবর্তনে এসেছে বলে বিদ্রোহীরা আঁচ করেছিল। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ওই সূত্র বলেছে, বাশার আল–আসাদের প্রতি আঙ্কারা নাখোশ হওয়ার পর বিদ্রোহীরা তাদের পরিকল্পনার বিস্তারিত তুরস্কের কাছে তুলে ধরেছিল। বার্তাটি এমন ছিল যে, ‘বছরের পর বছর অন্য উপায় কাজ করেনি। সুতরাং আমাদের পদ্ধতিতে চেষ্টা করি। আপনাকে কোনো কিছু করতে হবে না, শুধু হস্তক্ষেপ করবেন না।’

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
রয়টার্স ফাইল ছবি

এই যোগাযোগের বিস্তারিত খুঁটিয়ে দেখতে পারেনি রয়টার্স। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সিরিয়ার বিদ্রোহী হিসেবে স্বীকৃতদের প্রধান হাদি আল–বাহরা গত সপ্তাহে রয়টার্সকে বলেন, বিদ্রোহীদের চূড়ান্ত অভিযানের আগে এইচটিএস ও এসএনএর মধ্যে হালকা মাত্রায় যৌথ পরিকল্পনা হয়েছিল এবং তারা নিজেদের মধ্যে লড়াই না করা ও পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে সম্মত হয়েছিল।

হাদি আল-বাহরা আরও বলেন, সিরিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো কী করছে এবং তারা কী আলোচনা করছে, সেগুলো তুরস্কের সেনাবাহিনী দেখেছিল।

বাশার আল–আসাদ সরকারের পতনের দিন রোববার তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান দোহায় বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাশার আল–আসাদের সঙ্গে এরদোয়ানের যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং তুরস্ক জানত কিছু একটা আসছে।

অবশ্য শনিবার বাহরাইনে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক একটি সম্মেলনে তুরস্কের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী নুহ ইলমাজ বলেন, এই হামলার পেছনে আঙ্কারার হাত নেই। তাঁরা এতে সম্মতিও দেননি। বরং অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে তাঁরা আশঙ্কা–উদ্বেগে ছিলেন।

আলেপ্পো অভিযান নিয়ে এইচটিএস–আঙ্কারার বোঝাপড়ার বিষয়ে জানতে চেয়ে রয়টার্সের করা প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেয়নি তুরস্কের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এই যুদ্ধক্ষেত্র বিষয়ে তুরস্কের জানাশোনা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে দেশটির একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন যে, ‘এইচটিএস আমাদের কাছ থেকে কোনো আদেশ বা দিকনির্দেশনা পায়নি এবং তারা তাদের অভিযান নিয়ে আমাদের সঙ্গে সমন্বয়ও করেনি।’

আরও পড়ুন