ইসরায়েলি হামলায় গাজায় প্রতি ৫০ জনে ১ জন নিহত
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার ১৫ মাস পেরিয়ে গেছে। মাঝের সময়টায় প্রায় প্রতিটি দিন বোমার আঘাতে কেঁপে উঠেছে এ উপত্যকার বিভিন্ন প্রান্তর। হামলা, হতাহত আর বাস্তুচ্যুতি—মর্মান্তিক এসব ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন গাজাবাসী।
ঘটনার সূত্রপাত ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। ওই দিন ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে আকস্মিক হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। ইসরায়েলের দাবি, হামলায় নিহত হন ১ হাজার ১০০ জনের বেশি। প্রায় ২৪০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের অনেকে এরই মধ্যে মুক্তি পেয়েছেন। কেউ কেউ হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন।
হামাসের হামলার জবাবে ওই দিনই গাজায় তাণ্ডব শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী, যা এখনো চলছে। নারকীয় হামলায় অবরুদ্ধ গাজা কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকেই অবরুদ্ধ রয়েছে উপত্যকাটি।
নিহত ৪৬ হাজারের বেশি
গাজায় গত ১৫ মাসে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৪৬ হাজার ৭০৭ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শিশু ১৮ হাজার। এর অর্থ হলো, যুদ্ধচলাকালে গাজার মোট জনসংখ্যার প্রতি ৫০ জনের ১ জন নিহত হয়েছেন। তবে অনেক বিশ্লেষক আর মানবাধিকার সংগঠন মনে করছে, নিহত ব্যক্তির প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
দেশ-বিদেশে তুমুল সমালোচনার পরও গাজায় শাস্তিমূলক যুদ্ধ চালু রেখেছে ইসরায়েল। গাজার জনসংখ্যার অর্ধেকের বয়স এখন ১৮ বছরের নিচে। চলমান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ উপত্যকার কয়েক প্রজন্মের পরিবার নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে দেশটি।
লক্ষাধিক আহত
গাজায় চলমান যুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ১ লাখ ১০ হাজার ২৬৫ মানুষ আহত হয়েছেন। অর্থাৎ গাজায় প্রতি ২০ জনের ১ জন যুদ্ধে আহত হয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ বা প্রায় ২২ হাজার ৫০০ জনকে জীবনভর অসুস্থতা বয়ে বেড়াতে হবে। তাঁদের পুনর্বাসন জরুরি। কিন্তু তাঁরা কেউ সেটি পাচ্ছেন না, বিশেষ করে যাঁরা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন, তাঁদের পুনর্বাসন বেশি প্রয়োজন।
প্রতিদিন গাজার অন্তত ১০ শিশু এক কিংবা দুই পা-ই হারাচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ। ইসরায়েলি অবরোধের কারণে এসব শিশুর সামান্য কিংবা কোনো ক্ষেত্রে অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই অস্ত্রোপচার করাতে হচ্ছে। এটিও তাদের অঙ্গহানির কারণ।
অনেকেই নিখোঁজ
হতাহতের এসব সংখ্যার বাইরেও আশঙ্কা করা হচ্ছে, হাজারো মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। তাঁদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ধ্বংসস্তূপ সরানো ও কেউ বেঁচে থাকলে তাঁকে উদ্ধার করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও অপ্রতুল। স্বেচ্ছাসেবী ও উদ্ধারকারীরা নিজেদের হাতের ওপর ভরসা করে কাজ করছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো কত মানুষ আটকা আছেন, সেটি স্পষ্ট করে বলার সুযোগ নেই।
গাজায় প্রায় ৮৫ হাজার বিস্ফোরক ফেলা হয়েছে, এ তথ্য ফিলিস্তিনের পরিবেশ মানসংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, নির্বিচার বোমাবর্ষণের কারণে সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপ সরাতে এক দশকের বেশি লেগে যেতে পারে। সেখানে ৪ কোটি ২০ লাখ টনের মতো ধ্বংসস্তূপ জমা হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল।
শীত-ক্ষুধায় কাতর
কোনো সশস্ত্র সংঘাত চলাকালে সাধারণ মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষুধার্ত রাখা যুদ্ধাপরাধের শামিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠার জন্য করা রোম সংবিধিতে এমনটাই বলা আছে।
আল-জাজিরার ফল্ট লাইনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর জন্য ত্রাণ ও পানির সরবরাহ পদ্ধতিগতভাবে বন্ধ রেখেছে ইসরায়েল।
তীব্র শীতের মধ্যেও ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তাঁবুতে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে উদ্বাস্তু গাজাবাসীকে। অন্তত আটটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়ে।
গাজার ২৩ লাখ মানুষের প্রায় ১৯ লাখই ইসরায়েলি হামলায় উদ্বাস্তু হয়েছেন। তাঁদের প্রায় ৮০ শতাংশ শীত থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজনীয় জামাকাপড় কিংবা সুরক্ষা ছাড়া অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।
হামাস–নিয়ন্ত্রিত গাজার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উপত্যকাজুড়ে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার তাঁবু খাটানো হয়েছে। জরাজীর্ণ ও বসবাসের অযোগ্য এসব তাঁবুতে উদ্বাস্তুরা আশ্রয় নিয়ে আছেন।
ইসরায়েল ও হামাস—বিবদমান দুই পক্ষ গতকাল বুধবার যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছায় বলে জানায় যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে আগামী রোববার থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও যুদ্ধবিরতির কথা নিশ্চিত করেছেন। এই চুক্তির আওতায় গাজায় সংঘাত বন্ধের পাশাপাশি হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের মুক্তির পথও খুলবে।