ভারতে কি সাংবাদিকতার দিন শেষের পথে

বিজেপি সরকার সম্প্রতি ৪৫ সাংবাদিক, লেখক, সমাজকর্মীর বাড়ি ও দপ্তরে তল্লাশি চালিয়েছে, গ্রেপ্তারও করা হয়েছে দুজনকে। ডিজিটাল মাধ্যমে সরকারবিরোধী সাংবাদিকদের জনপ্রিয়তায় বিজেপি উদ্বেগ থেকে এসব করছে। আবার নতুন করে ডিজিটাল ইন্ডিয়া অ্যাক্ট আইন করছে। এতে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা আরও চাপে পড়বেন।

ভারতের সংবাদ পোর্টাল নিউজ ক্লিক-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দিল্লিতে সাংবাদিকদের বিক্ষোভ। ৪ অক্টোবর
ছবি: এএনআই

ভারতে গত কয়েক দিনে ৪৫ জনের বেশি সাংবাদিক, লেখক ও সমাজকর্মীর বাড়িঘর তল্লাশি করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। আর্থিক দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে তাঁদের কার্যালয়েও তল্লাশি অভিযান চালানো হয়।

ভারতে এমন ঘটনা নজিরবিহীন। একসঙ্গে ১২ জন সাংবাদিকের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল, যারা সাধারণত ‘সন্ত্রাসবাদ ও সংঘটিত অপরাধ’-এর তদন্ত করে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস এ তথ্য জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত ৪৫ জনের বেশি সংবাদকর্মী তো তল্লাশি ও জেরার মুখে পড়েছেনই, এর বাইরে ভারতের খ্যাতিমান লেখক অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে দায়ের একটি মামলা আবার চালু করতে ১০ অক্টোবর অনুমতি দিয়েছেন দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর। অরুন্ধতীর নামে অভিযোগ ছিল, তিনি ‘উত্তেজক’ ভাষণ দিয়েছেন।

মামলাটি নিয়ে কংগ্রেস তখন আগ্রহ দেখায়নি। ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কংগ্রেসের পি চিদাম্বরম গণমাধ্যমকে গত মঙ্গলবার বলেছেন, ‘রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে এ মামলা চালানোর আইনি যৌক্তিকতা সে সময়ে ছিল না, এখনো নেই।’

চলতি মাসে আরও যাঁদের জেরা করা হয়, তাঁদের মধ্যে ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিশেষ সেল। এরপর বহুল পরিচিত সংবাদ ওয়েবসাইট ‘নিউজক্লিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং তার এক কর্মীকে সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেপ্তার করে তারা।

অন্তত দুজন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা ও সুবোধ বর্মার বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। জেরা করা হয় পরঞ্জয়কে। একজন কার্টুনিস্টসহ অন্তত আরও নয়জন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের বাড়িতে তল্লাশির পাশাপাশি কয়েকজনকে জেরা করা হয়।

আরও পড়ুন

কেন বিজেপি এমন করল

ভারতে মাস ছয়েক পর লোকসভা নির্বাচন। এর আগে অন্তত তিনটি বড় রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। কিন্তু এমন একটা সময়ে কেন এমন করতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি), সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

ভারতে সাংবাদিকদের এমন সাংঘাতিক কোনো ক্ষমতা নেই যে তাঁরা বিজেপির মতো গভীর সামাজিক শিকড়সম্পন্ন একটি দলকে উপড়ে ফেলতে পারেন। তবু কাজটি তারা করছে এ কারণে, সামাজিক ও ডিজিটাল মাধ্যমের বিস্তার হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ডিজিটাল মাধ্যমে সংবাদ এবং প্রযোজক-উপস্থাপকদের কথাবার্তা সাধারণ মানুষকে বেশ ভালোভাবেই প্রভাবিত করছে।

প্রায় দেড় দশক আগে ‘আরব বসন্ত’ নামের আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়ে পশ্চিম এশিয়ার একাংশ ও প্রায় গোটা আফ্রিকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল মাধ্যম অভ্যুত্থানের পক্ষে জনমত গঠনে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। এর জেরে একাধিক সরকার পড়ে গিয়েছিল। দেড় দশকে আরও অনেক দেশে গণ-আন্দোলনে ডিজিটাল মাধ্যম বড় ভূমিকা রেখেছে। এটাই ভয় বিজেপির।

বিজেপি জানে, ডিজিটাল মাধ্যম কীভাবে কাজ করে। এখানে শুধু প্রতিপক্ষকে গালমন্দ করলে হয় না, একটা ‘ন্যারেটিভ’ (বয়ান) বা গল্প তৈরি করে আক্রমণ করতে হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে এটা কীভাবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে হয়, ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনে সেটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের দল ভালোভাবেই দেখিয়েছিল। অবশ্য ২০১৬ সালের আগে ২০১৪ সালে ভারতের নির্বাচনে ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিল বিজেপি।

২০১৯ সালের নির্বাচনেও ডিজিটাল মাধ্যমকে প্রায় একচেটিয়া ব্যবহার করেছিল বিজেপি। এবার চিত্র অন্য রকম। এবার সাংবাদিকদের একাংশ, কার্টুনিস্টরা এবং স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানরা রাজনৈতিক ব্যঙ্গরসের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল মাধ্যমকে বেশ ভালোভাবেই ব্যবহার করছেন। তীব্র শ্লেষধর্মী রসিকতা দিয়ে তাঁরা বিজেপিকে নিয়মিত আক্রমণ করছেন। এত দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে প্রায় এককভাবে বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি সেলবিরোধীদের আক্রমণ করছিল।

আরও পড়ুন

কেন বাড়ছে উদ্বেগ

বিজেপির আরেকটি বিপদ দেখা দিয়েছে। ভারতে সব রাজনৈতিক দলই জানে, নির্বাচনী রাজনীতি কতটা জটিল! এই জটিল প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে যে বিষয়টি রয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে—‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি’ বা ক্ষমতাসীনবিরোধী ভোট। ক্ষমতায় বেশি দিন থাকলে সরকারবিরোধী ভোট ধীরে ধীরে স্ফীত হয়।

বিষয়টি বিজেপির গবেষণা ও সমীক্ষায়ও উঠে আসছে। একদিকে পাল্টা ‘বয়ান’, অন্যদিকে জনপ্রিয়তায় আংশিক ভাটার আশঙ্কা বিজেপিকে ‘নিউজক্লিক’-এর মতো ক্ষুদ্র সমালোচক প্রতিষ্ঠানের দপ্তরে তালা ঝোলাতে বাধ্য করেছে।

বিজেপির জনপ্রিয়তায় ভাটার একটা পরোক্ষ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেসব সাংবাদিক ও ডিজিটাল মাধ্যমে ‘প্রভাবশালী’ স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানরা (ইনফ্লুয়েন্সার) যখন বিজেপিবিরোধী একটা ‘বয়ান’ দিচ্ছেন, তখন দ্রুত তাঁদের দর্শক বাড়ছে। উল্টো দিকে সরকারপক্ষের সাংবাদিকদের তেমন বাড়ছে না। দুই শিবিরের প্রধান দুই সাংবাদিকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির পক্ষের অর্ণব গোস্বামীর চ্যানেল ‘রিপাবলিক’ ইংরেজির ইউটিউব চ্যানেলে গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৫৮ লাখ। তবে তাঁর ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেল নেই। পাশাপাশি বিজেপি ও মোদিবিরোধী সাংবাদিকদের মধ্যে প্রধান রভিশ কুমারের ইউটিউব চ্যানেলের বয়স এখনো এক বছর হয়নি। অথচ তাঁর চ্যানেলের গ্রাহক ৭৩ লাখ। অর্থাৎ বিজেপির পক্ষের মুখ্য সাংবাদিকের চ্যানেলের চেয়ে বিজেপিবিরোধী প্রধান সাংবাদিকের ব্যক্তিগত চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা অনেক বেশি।

এই তথ্য হয়তো সাধারণ মানুষের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প বা বিজেপির কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পরপর নির্বাচনে এঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। সে জন্যই রভিশ কুমারদের নিয়ে উদ্বেগ। তবে বিজেপি অন্যান্য দলের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। ফলে গণমাধ্যম নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা অন্য রকম। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

ইন্দিরা গান্ধী ও নরেন্দ্র মোদির পার্থক্য

৪৮ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জরুরি অবস্থা চলাকালে প্রবীর পুরকায়স্থকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদ জ্ঞান প্রকাশের বই ‘ইমার্জেন্সি ক্রনিক্যালস’-এর বড় অংশই সে সময় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রবীরের ওপরে পুলিশি নির্যাতন নিয়ে। এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থার সময় গণমাধ্যম ‘বশ’ করতে পারেননি। সরাসরি সংঘাতে গিয়েছিলেন। ফলে গণমাধ্যম প্রায় পুরোপুরি তাঁর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। এই ভুল বিজেপি করেনি।

গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে বিজেপি অনেক বেশি কৌশলী। ওপর থেকে চাপানো ‘সেন্সরশিপের’ বদলে ভেতর থেকে ব্যবস্থার পরিবর্তন করেছে বিজেপি। ইন্দিরা গান্ধীর মতো সবার ওপর আক্রমণের পথে না গিয়ে, নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ দিয়ে তাদের ব্যবস্থাপনা, সম্পাদক ও সাংবাদিক পরিবর্তন করে দেওয়াই ছিল বিজেপির কৌশল। এতে বিজেপি সফল। ভারতে রাজনীতি-গণমাধ্যমের সম্পর্কের প্রশ্নে এটা একটা বড় পরিবর্তন বটে। গবেষণারও বিষয়।

বিজেপি যেটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, সেই ফাঁকটুকু ধরে ডিজিটাল মাধ্যমে বিজেপিকে বিব্রত করছেন প্রবীর পুরকায়স্থ, রভিশ কুমার, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা থেকে কুনাল কামরার মতো স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানরা। এ কারণেই সাংবাদিকদের ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেশাদার ব্যক্তিদের ভয় দেখাতে হচ্ছে। এঁদের চাপে রেখে অন্যান্য ডিজিটাল উপস্থাপক, ‘স্যাটায়ারিস্ট’ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও সাবধান করা হচ্ছে, যাতে নির্বাচনের আগে তাঁরা সরকারকে অপদস্থ না করেন। করলে কপালে সন্ত্রাস দমন আইন।

সন্ত্রাস দমন আইনে ভারতের সাংবাদিক এবং ‘অভিজাত’ সমাজের সদস্যদের ইউএপিএতে (বেআইনি তৎপরতা প্রতিরোধ আইন) গ্রেপ্তারও সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ এক অদ্ভুত আইন, যদিও আইনটি কংগ্রেসই প্রণয়ন করেছিল। তবে কংগ্রেস আইনটি প্রধানত মুসলমান ও আদিবাসীদের ওপরে প্রয়োগ করেছিল। প্রভাবশালী শহুরে ‘অভিজাত’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইন তেমন প্রয়োগ করেনি কংগ্রেস। কিন্তু বিজেপি সুকুমার রায়ের ভাষায় ‘শিবঠাকুরের আপন দেশের’ আইনকে মধ্য-উচ্চবিত্তের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে।

এ আইনে প্রায় কেউই দোষী সাব্যস্ত হন না। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ইউএপিএতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মাত্র ৩ শতাংশের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ২ দশমিক ২ শতাংশের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ইউএপিএতে দ্রুত জামিন পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

ফলে তিন বছর বা তারও বেশি সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারাগারে থাকতে হয়। জামিনে বের হলেও নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে আরও কয়েক বছর লেগে যায়। ইউএপিএ নিয়ে প্রধান বিচারপতি এন ভি রামান্নার ভাষ্য, ‘দ্য প্রসেস ইজ দ্য পানিশমেন্ট’ (বিচারপ্রক্রিয়াই শাস্তি)।

প্রবীর পুরকায়স্থের মতো পেশাদার একজন গ্রেপ্তার হলে একটা সংস্থা অকেজো হয়ে পড়বে। আদালতের চক্করে তাঁর জীবনের বেশ কিছু বছর কেটে যেতে পারে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অনেকেই হয়তো সাংবাদিকতা ছেড়ে দেবেন। এক যুগ পর হয়তো পুরকায়স্থ নির্দোষ প্রমাণিত হবেন, কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যাবে।

আরেকটি অবাক করা ঘটনা হলো—তাঁরা সবাই চীনের ‘দালালি’ করছেন বলে অভিযোগ। কিন্তু চীনকে কখনোই কোনো প্রশ্ন করা হচ্ছে না। এমনকি তারা ভারতের ২০ সৈনিককে হত্যা করলেও।

মজার বিষয়, প্রবীর পুরকায়স্থ চীনের যে দুই মোবাইল কোম্পানি শাওমি ও ভিভোকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন বলে অভিযোগ—তাদের মধ্যে শাওমি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ‘পিএম কেয়ারস ফান্ড’ এবং মুখ্যমন্ত্রীদের ত্রাণ তহবিলে অর্থ সাহায্য দিয়েছিল।

২০২০ সালে ভারতের গণমাধ্যম দ্য ওয়্যার-এর এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছিল। কিন্তু যত দোষ ক্ষুদ্র গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

নিউইয়র্ক টাইমসের অলস সাংবাদিকতা

নিউজক্লিক-এ তালা ঝোলানোর সম্ভবত আরেকটি কারণ মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন। প্রমাণহীন এই প্রতিবেদন তাদের সাংবাদিকতার বিচারে এতটাই নিচু মানের যে কার্যত নিজেদের লেখার বিপক্ষেই একটি প্রতিবেদন তারা ছেপেছে।

সেই লেখায় বামপন্থী নেত্রী কবিতা কৃষ্ণানকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। কৃষ্ণান বলেছেন, ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, এমন সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের অজুহাত হিসেবে (নিউইয়র্ক টাইমস–এর) প্রতিবেদন মোদি সরকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে বলে আশঙ্কা করছি।’ ভারতে একাধিক সম্পাদক এখন বলছেন, নিউইয়র্ক টাইমস-এর এই প্রতিবেদন ‘অলস সাংবাদিকতা’র উদাহরণ।

গণমাধ্যমের অবস্থা যখন এই, তখন নতুন করে আসছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া অ্যাক্ট-২০২৩’। এ আইনে সরকার যদি মনে করে, কোনো সাংবাদিক ভুয়া তথ্য দিচ্ছেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারবে। যেমন নিউজক্লিক-এর ক্ষেত্রে এফআইআরে অভিযোগ করা হয়েছে, কৃষক আন্দোলনের সময় সাংবাদিকেরা কৃষকদের উত্তেজিত করেছিলেন। আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশের মতো ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কোনো নিশ্চয়তা সংবিধান দেয় না। নতুন ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ যে সংবাদমাধ্যমকে আরও চেপে ধরবে, তা বলা বাহুল্য।

আরও পড়ুন

তবে বিজেপি সরকারের এ উদ্যোগে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাসে সংবাদমাধ্যমকে শাস্তি দিয়ে জনগণকে সাবধান করার ভালো উদাহরণ রয়েছে। প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯৩৩ সালে নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় আসার পরের ১০ বছরে জার্মানির মোটামুটি ৩ হাজার ৬০০ সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

যারা বেঁচেবর্তে ছিল, তাদের অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করতেন ফ্রাঞ্জ ইয়া নামে নাৎসি পার্টির ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ী। ভারতেও এমন দুই-তিনজন ব্যবসায়ী প্রায় গোটা মূলস্রোতের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও ডিজিটাল মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে নির্দিষ্ট দলের তথ্যপ্রযুক্তি সেল।

এ অবস্থায় চাকরি বাঁচাতে সাংবাদিকদের বড় একটা অংশ ভুলে গেছেন সংবাদ ও প্রেস বিজ্ঞপ্তির পার্থক্য। এমন একটা সময়ে আরও একটি কঠোর আইন সংবাদমাধ্যমের ওপরে চাপালে জনসংযোগ ও সংবাদ সংস্থার পার্থক্য হয়তো ভারতে মুছে যাবে, যেমনটা গিয়েছিল ১৯৩০-এর দশকের জার্মানিতে।