পাকিস্তানের জেনারেলরা কীভাবে ইমরান খানকে চুপ করিয়ে দিচ্ছেন

নিজ দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) এক সমাবেশে ইমরান খান। করাচি, পাকিস্তান, ৪ জুলাই ২০১৮ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বারবার অস্বীকার করলেও ইমরান খানকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে গুজব। দেশটির সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী নাকি কারাগারে মারা গেছেন।

২০২৩ সাল থেকে কারাবন্দী থাকা ইমরান খানকে কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁর পরিবার বা আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে তাঁর শারীরিক অবস্থান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সরকার বলছে, তিনি সুস্থ আছেন। কিন্তু এ আশ্বাসে পরিবার ও সমর্থকদের উদ্বেগ কমেনি। তাঁরা বারবার তাঁর জীবিত থাকার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ চাইছেন।

খানের মৃত্যুর গুজব অতিরঞ্জিত মনে হলেও তাঁকে গণমানুষের কল্পনা থেকে মুছে ফেলতে ক্ষমতাসীনদের তৎপরতা প্রকৃতই সত্য এবং তা প্রতি সপ্তাহেই যাচাই করার যোগ্য। ইতিমধ্যে তিনি ১৪ বছরের সাজা পেয়েছেন। আরও ১৫০টির বেশি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে আছে, রাষ্ট্রীয় উপহার চুরি করা থেকে শুরু করে সেনা সদর দপ্তরে সহিংস হামলায় উসকানি দেওয়া পর্যন্ত অভিযোগ। এসব মামলায় দোষী হলে তাঁকে বহু বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে।

খানের ক্ষমতায় উঠে আসা অলৌকিক মনে হতে পারে। কিন্তু যাঁরা পাকিস্তানের ইতিহাস সম্পর্কে জানেন, তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন, তাঁর কারাগারে যাওয়া ছিল প্রায় অবধারিত। গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রত্যেক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে কোনো না কোনো সময় কারাভোগ করতে হয়েছে। এটা যেন পদটিরই অংশ। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৯ সালে হত্যা মামলায় তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ৪৫ বছর পর, ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট জানান, তাঁর ফাঁসির রায় ছিল সম্ভবত ন্যাবিচারের ঘাটতির ফল।

ইমরান খানের মৃত্যুর গুজব অতিরঞ্জিত মনে হলেও তাঁকে গণমানুষের কল্পনা থেকে মুছে ফেলার জন্য ক্ষমতাসীনদের তৎপরতা যে সত্য এবং তা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ঘটছে; বোঝা যায়। ইতিমধ্যে তিনি ১৪ বছরের সাজা পেয়েছেন। আরও ১৫০টির বেশি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ডের পর পাকিস্তানের সব প্রধানমন্ত্রীই শেষ পর্যন্ত কারাগার থেকে জীবিত বেরিয়ে এসেছেন। কেউ কেউ আবার ক্ষমতায়ও ফিরেছেন। এর নিয়মটা সহজ। একসময় তাঁরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করেন, দেশ ছাড়েন এবং সময়ের অপেক্ষা করেন। সেনাবাহিনীরও আছে একটি ‘প্লেবুক’ (কীভাবে, কোন পরিস্থিতি সামলাতে হবে সেই কৌশল)। যেসব প্রধানমন্ত্রী তাঁদের ক্ষমতা আছে বলে সত্যি ভাবতে শুরু করেন, পূর্বনির্ধারিত কৌশলে তাঁদের সামাল দেওয়া হয়। রাজনীতিবিদদেরও আছে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার নিজস্ব নানা কৌশল।

এ কারণেই পাকিস্তানের রাজনীতি বোঝেন—এমন সবাই মনে করতেন, একসময় ইমরান খানের জেলে যাওয়া অনিবার্য। শুধু প্রশ্ন ছিল, কীভাবে তা ঘটবে। কয়েক সপ্তাহ কারাগারের নিঃসঙ্গতায় থাকার পর কি তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করে লন্ডনে নির্বাসনে চলে যাবেন? নাকি বিশ্বমানের খেলোয়ার, স্বাস্থ্যসচেতন ও অত্যন্ত জেদি ইমরান খান নিজের ভাগ্যে বিশ্বাস রেখে লড়াই চালিয়ে যাবেন?

আরও পড়ুন

দুই বছর কারাগারে থেকেও ইমরান এখনো দমে যাননি। তিনি পাকিস্তানের সবচেয়ে জোরালো বিরোধী কণ্ঠ। একই সঙ্গে সেনাবাহিনী ও সরকারের বড় মাথাব্যথাও। আইনজীবী, দলের নেতা–কর্মী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় দল—সবাই মিলে তাঁর বার্তা বাইরে পৌঁছে দেয়। তিনি সরকারের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন, সমালোচনা করেন যাঁরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছেন তাঁদের।

ইমরান খানের ছবি হাতে তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) সমর্থকদের বিক্ষোভ। করাচি, পাকিস্তান, ২১ নভেম্বর ২০২৫
ছবি: এএফপি

সেনাবাহিনী ও সরকার চেষ্টা করছে ইমরান খানকে টেলিভিশনের খবর, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, জনগণের স্মৃতি—সব জায়গা থেকে মুছে ফেলতে। এমনকি তাঁর নাম নেওয়াও নিষেধ। কিছু টেলিভিশন চ্যানেল তাঁকে ‘কাসিমের বাবা’ বলে উল্লেখ করে। ব্রিটেনে থাকা তাঁর দুই ছেলের একজন কাসিম খান। জুন মাসে যখন তাঁর দুই ছেলে পাকিস্তানে এসে বাবার মুক্তির আন্দোলন করতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁদের গ্রেপ্তার করার হুমকি দেওয়া হয়। এখন আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও পরিবার ও আইনজীবীদের সঙ্গে ইমরান খানের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ইমরান আগেই এমন পরিস্থিতির কথা ভেবে রেখেছিলেন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি যখন তাঁর দল এত ছোট ছিল যে একটি ঘরে থেকেই কাজ চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল, তখন তিনি অনুসারীদের বুঝিয়েছিলেন, সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করতে দরকার চারটি বড় শহরে মাত্র ২০ হাজার মানুষকে রাস্তায় নামানো। এতে জেনারেলরা কী করবেন, বুঝে উঠতে পারবেন না। কিন্তু পরে তিনি বুঝলেন, পাকিস্তানে ক্ষমতায় যেতে সেনা সদরের দরজা পেরোতেই হবে। একসময় ওই জেনারেলরাই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বিভিন্নভাবে তাঁকে ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করেন। এর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করা থেকে শুরু করে তাঁদের কারাগারে পাঠানো পর্যন্ত—সবাই করা হয়।

আরও পড়ুন

শেষ পর্যন্ত জেনারেলদের সঙ্গে ইমরানের সম্পর্কও খারাপ হয়। তখন চেষ্টা করেছিলেন তাঁর কল্পনার সেই জনসমর্থন দেখাতে। তাঁর সমর্থকেরা এক জেনারেলের বাড়িতে হামলা ও সামরিক স্থাপনাগুলোয় আক্রমণ করেন। সেনারা এটাকে অভ্যুত্থানের চেষ্টা বলে মনে করেন এবং ব্যর্থ অভ্যুত্থানকারীদের যেভাবে সামলানো হয়, সেভাবেই ব্যবস্থা নেন। ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ভেবেছিলেন, জনতার ঢল আসবে, জেলের দরজা ভেঙে তাঁকে বের করে নেবে। মানুষ জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলেও সেনাবাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নেয়। দলের কর্মীদের তুলে নেওয়া হয়, নেতাদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার বা আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে শুধু পরিবার ও কয়েকজন অনুগত নেতাই থাকেন। তাঁরা সপ্তাহে একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য লড়াই করতেন। এখন সে সুযোগও বন্ধ।

পাকিস্তানের রাজনীতি বোঝেন—এমন সবাই মনে করতেন, একসময় ইমরান খানের জেলে যাওয়া অনিবার্য। শুধু প্রশ্ন ছিল, কীভাবে তা ঘটবে। কয়েক সপ্তাহ কারাগারের নিঃসঙ্গতায় থাকার পর কি তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করে লন্ডনে নির্বাসনে চলে যাবেন? নাকি বিশ্বমানের খেলোয়ার, স্বাস্থ্যসচেতন ও অত্যন্ত জেদি ইমরান খান নিজের ভাগ্যে বিশ্বাস রেখে লড়াই চালিয়ে যাবেন?

এ সময়েই নজিরবিহীনভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। সম্প্রতি তিনি একটি সাংবিধানিক সংশোধন করিয়েছেন; যেন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীও তাঁর অধীন হয়। তাঁর মেয়াদ তিন বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। তাঁকে সারা জীবন সেনাবাহিনীর পোশাকে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং আজীবন মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ফলে জেনারেলরা তাঁদের জন্য একজন ‘অনুগত’ প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজন আরও কমিয়ে ফেলেছেন।

আরও পড়ুন

কারাগারের বাইরে চলা এ ক্ষমতা দখলের খেলায় ইমরান খান নিশ্চয়ই বুঝেছেন, গণ–অভ্যুত্থানের স্বপ্নেরও সীমা আছে। তাঁর বয়স এখন ৭৩। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগার থেকে বেরোনোর জন্য যেসব বিষয় দর–কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারতেন, বর্তমান সামরিক গোষ্ঠী সেগুলোও সরিয়ে ফেলেছে। এমনকি তাঁর বিরোধীরাও বলেন, ইমরান আপস করেননি। কারণ, তাঁর কাছে প্রকৃতপক্ষে কোনো আপসের প্রস্তাবই নেই।

দুই বছর কারাগারে থেকেও ইমরান এখনো দমে যাননি। তিনি পাকিস্তানের সবচেয়ে জোরালো বিরোধী কণ্ঠ। একই সঙ্গে সেনাবাহিনী ও সরকারের বড় মাথাব্যথাও। আইনজীবী, দলের নেতা-কর্মী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় দল—সবাই মিলে তাঁর বার্তা বাইরে পৌঁছে দেয়। তিনি সরকারের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন, সমালোচনা করেন যাঁরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছেন তাঁদের।

কারাগারে যাওয়ার পর থেকে ইমরান খান যে রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন, তা–ও কাজ করেনি। তাঁর সমর্থকেরা আদালতে যাচ্ছেন, কিন্তু বিচারকেরা নিজেদের পদ রক্ষায় বেশি ব্যস্ত। সমর্থকেরা এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। বার্সেলোনা ও লন্ডনে তাঁদের অবস্থান কর্মসূচিও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সমর্থকেরা কংগ্রেস ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তাঁর মুক্তির জন্য তদবির করছেন। কিন্তু তা বেশ কঠিন। কারণ, ট্রাম্প সম্প্রতি মুনিরকে বলেছেন, ‘আমার সবচেয়ে প্রিয় ফিল্ড মার্শাল।’

আরও পড়ুন
পাকিস্তানের কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
ছবি: ইমরান খানের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া

এদিকে ইমরান খানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা, যাঁরা সবাই তাঁর মতোই সেই একই কারাগারে সময় কাটিয়েছেন, তাঁকে প্রতিহত করতে গিয়ে নিজেদের ক্ষমতাই কমিয়ে ফেলেছেন। মুনিরের ক্ষমতা বাড়ানো বিতর্কিত সংবিধান সংশোধনের পর তাঁরা কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতাও সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন। যেন তাঁরা বলছেন, তাঁকে জেলে রাখুন, আমরা আপনাদের সব কথা মানব। দীর্ঘ অভ্যুত্থানের ইতিহাস থাকা এ দেশে সেনাবাহিনীও খুশি। ঘোষণা ছাড়া সামরিক শাসন চালাতে তারা পুতুল নেতাদেরই পছন্দ করে।

১৯৯২ সালে পাকিস্তান যখন ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতে, তখনই ইমরান খানের ‘কিংবদন্তি’র ভাবমূর্তি তৈরি হয়। পরপর ম্যাচ হারার পরও তিনি দলকে বলেছিলেন, কোণঠাসা বাঘের মতো লড়তে হবে। তাঁর টি-শার্টেও লেখা ছিল সে কথা। কিন্তু এখন সেই বুড়ো ‘বাঘ’টিকে খাঁচায় বন্দী করে রেখেছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী মনে করে, তারা খাঁচার চাবিটাও ফেলে দিয়েছে। তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে গুজব ভুল হতে পারে। কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার, এখন খাঁচার ভেতর থেকে তাঁর সপ্তাহিক ‘গর্জন’ আর অভিযোগ-সমালোচনার আওয়াজ পুরোপুরি থামিয়ে দিতে চায় তারা।

আরও পড়ুন