‘এবার ঈদে উপহার কেনা কঠিন হয়ে পড়বে’

করাচিতে ঈদের নামাজ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

নওরিন আহসানের বাড়ি পাকিস্তানের করাচিতে। একটি স্কুলে চাকরি করেন। একজন পাকিস্তানির গড় মাসিক বেতনের দ্বিগুণের বেশি পান তিনি। তারপরও সংসারের খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে এখন সন্তানদের বাড়িতেই লেখাপড়া করাচ্ছেন নওরিন।  

পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২২ কোটি। নওরিনের মতো তাঁদের বেশির ভাগই এখন চরম দুর্দশায় রয়েছেন। কারণ, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট। দেশটির সরকার পাল্লা দিয়ে পাকিস্তানি রুপির মান কমাচ্ছে। কমানো হচ্ছে নানা খাতে দেওয়া সরকারি ভর্তুকিও। এতে করে হু হু করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম।

শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। এই মাসে মুসলমানরা ইফতারে একটু ভালো খাবারের আয়োজন করতে চান। প্রস্তুতি নেন ঈদ উদ্‌যাপনের। তবে এবারের রমজানে পাকিস্তানিরা আরও দুর্দশায় পড়বেন বলে মনে করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে জরুরি ঋণসহায়তা (বেইল আউট) চেয়েছে ইসলামাবাদ। এই বেইল আউট পাওয়ার জন্য আইএমএফের অন্যতম শর্ত ভর্তুকি কমাতে হবে। তবে বেইল আইট নেওয়ার ঘটনা পাকিস্তানে এই প্রথম নয়। ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত আইএমএফ থেকে পাঁচবার ঋণ নিয়েছে তারা।

এবারের সংকট আরও গভীর বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদদের অনেকে। কারণ, এবার জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে আয়কর। এতে করে শিক্ষিত পেশাজীবীদের ওপরও বড় ধাক্কা এসেছে। তাঁদের অনেকে বলেছেন, জীবন চালাতে প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস তালিকা থেকে বাদ দিতে হয়েছে তাঁদের।

যেমন নওরিন বলছিলেন, ‘আমরা বাইরে খাবার খাওয়া বাদ দিয়েছি। মাছ–মাংস কম কিনি। টিস্যু পেপার ও ডিটারজেন্ট পাউডারের ব্যবহার কমিয়েছি। এমনকি কাউকে উপহারও দিই না।’

করাচিতে সস্তা রুটির দোকানের সামনে দীর্ঘ লাইন
ছবি : রয়টার্স

পাকিস্তানে সরকারি চাকরিতে ন্যূনতম বেতন প্রায় ২৫ হাজার রুপি। এর চেয়ে বেশি বেতন পেয়েও অনেকের মাস চলছে না। গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। গত ৫০ বছরের মধ্যে সেখান মূল্যস্ফীতির পারদ এতটা চড়েনি।

বেতনের অর্থে যে মানুষের মাস চলছে না, তার একটি প্রমাণ দিল পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠান ‘আভি স্যালারি’। নিজেদের দুই লাখ সেবাগ্রহীতাকে বেতন পাওয়ার আগে ধার হিসেবে অর্থ দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। পরে বেতন পেলে তা পরিশোধ করে দিতে হয়। আভি স্যালারির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওমাইর আনসারি বলেন, গত তিন মাসে আগাম অর্থ নেওয়ার পরিমাণ পাঁচ গুণ বেড়েছে। বেশির ভাগ সেবাগ্রহীতা এই অর্থের দুই–তৃতীয়াংশ খরচ করছেন নিত্যপণ্য কিনতে।

আরও পড়ুন

পাকিস্তানের দরিদ্রদের হারানোর মতো আর কিছু নেই বলে মনে করেন আবিদ সুলেরি। তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ইনস্টিটিউট অব পাকিস্তানের একজন কর্মকর্তা। আবিদ সুলেরি বলেন, শিক্ষিত পেশাজীবীদের ক্রয়ক্ষমতা ও সঞ্চয় কমেছে। নিত্যপণ্য কিনতে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকের তো এগুলো নাগালের বাইরে চলে গেছে।  

পাকিস্তানে এখন ২৮২ রুপির বিনিময়ে ১ ডলার পাওয়া যায়।

এমন সংকটের মধ্যেই আবার শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। এই মাসে মুসলমানরা ইফতারে একটু ভালো খাবারের আয়োজন করতে চান। প্রস্তুতি নেন ঈদের উদ্‌যাপনের। তবে এবারের রমজানে পাকিস্তানিরা আরও দুর্দশায় পড়বেন বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মার্চ ও এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি অন্তত ৩৫ শতাংশ বাড়বে।

আরও পড়ুন
অর্থনৈতিক সংকটে পাকিস্তানে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। কম দামে খাদ্য কিনতে সরকারি বিক্রয়কেন্দ্রে সাধারণ মানুষের ভিড়
ছবি: রয়টার্স

একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক আহমেদ। কর্মক্ষেত্রে ঝামেলায় পড়তে পারেন, এমন আশঙ্কায় নিজের পুরো নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি। আহমেদ বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে খাবারের পরিমাণ কমিয়েছি। এবারের ঈদে উপহার ও মিষ্টান্ন কেনা আমাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়বে।’ অথচ উপহার দেওয়া ও মিষ্টান্ন কেনা একধরনের ঐতিহ্য বলে জানান তিনি।  

আরও পড়ুন

এই পেশাজীবীদের অনেকেই এখন ভালো জীবনের আশায় দেশের বাইরে চলে যেতে চাচ্ছেন। এমন একজনের নাম খালিক, পেশায় চিকিৎসক। তিনি বলেন, তাঁর স্ত্রীও চিকিৎসক। এখন যতটা সম্ভব তাঁরা কাজ করছেন। এ থেকে অর্থ জমিয়ে তাঁরা যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করবেন।

পাকিস্তানে এখন ২৮২ রুপির বিনিময়ে ১ ডলার পাওয়া যায়। এটা খালিকের খরচ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ, যুক্তরাজ্যের যাওয়ার জন্য পরীক্ষায় অংশ নিতে হলে তাঁকে বৈদেশিক মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তবে খালিকের কথা একটাই, ‘আমরা ওই পরীক্ষায় পাস করতে চাই, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাই।’

আরও পড়ুন