ইমরান খানের সাক্ষাৎ না পাওয়ায় কেন উত্তাল হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের রাজনীতি
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দী ইমরান খানের পরিবারের সদস্যরা প্রায় এক মাস ধরে বলে আসছেন, তাঁর সঙ্গে তাঁদের দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। বিষয়টি তাঁর সমর্থকদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তিনি সুস্থ আছেন কি না, তা নিয়েও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
রাজাধানী ইসলামাবাদের কাছে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতর কেন্দ্রীয় কারাগার আদিয়ালা জেলে আছেন ইমরান খান। গত মঙ্গলবার তাঁর বোন উজমা খান অবশেষে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পেরেছেন। তবে উজমা জানিয়েছেন, ইমরানের স্বাস্থ্য ভালো আছে বলেই মনে হচ্ছে।
তবে ইমরান খানকে অত্যন্ত খারাপ পরিবেশে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁর বোন উজমা। তিনি ইমরানের কারাবাসকে ‘মানসিক নির্যাতন’ আখ্যা দিয়েছেন।
দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ইমরান বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
ইমরানের খানের স্ত্রী বুশরা বিবিও এই দুর্নীতি মামলাগুলোর একটিতে জমি ঘুষ নেওয়ার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাত বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। তবে এই দম্পতি তাঁদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
চলুন, কারাগারে ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে জেনে নিই
ইমরান খান কেন কারাগারে?
ইমরান খান ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি দুর্নীতির মামলায় ২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার হন। তিনি বেশ কয়েকটি মামলায় কারাদণ্ড ভোগ করছেন। মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে—
আল-কাদির ট্রাস্ট মামলা: এ মামলায় ইমরান খান এবং তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে এক রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারের কাছ থেকে আল-কাদির ট্রাস্টের মাধ্যমে ঘুষ হিসেবে সাত বিলিয়ন রুপি মূল্যের জমি নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। ট্রাস্টটি ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ইমরান খানকে ১৪ বছরের এবং তাঁর স্ত্রীকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ইমরান খানকে অত্যন্ত খারাপ পরিবেশে রাখা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তাঁর বোন উজমা। তিনি ইমরানের কারাবাসকে ‘মানসিক নির্যাতন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
ব্লার্ব- দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ইমরান বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
তোশাখানা মামলা: গ্রেপ্তারের পর এক পর্যায়ে ইমরান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৪ কোটি রুপির বেশি মূল্যের রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। তাঁকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
সন্ত্রাসবিরোধী অভিযোগ: ইমরান খান গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তাঁর সমর্থকেরা বিভিন্ন সময় পাকিস্তানজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ করেছেন। এসব বিক্ষোভের সুবাদে সন্ত্রাসবিরোধী নানা অভিযোগের মুখে পড়েছেন তিনি। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে রাওয়ালপিণ্ডির একটি সন্ত্রাসবিরোধী আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এতে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন। এ মামলার বিচারপ্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি।
সাইফার মামলা: ইমরানের খানের বিরুদ্ধে ২০২২ সালে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ইসলামাবাদে পাঠানো একটি গোপন তারবার্তা (সাইফার) জনসমক্ষে প্রকাশ করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। ২০২৩ সালের অক্টোবরে পিটিআইয়ের জ্যেষ্ঠ নেতা শাহ মাহমুদ কুরেশি ও ইমরান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। মামলায় তাঁরা দুজনই দোষী সাব্যস্ত হন এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তাঁদের প্রত্যেককে ১০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ইদ্দত মামলা: বুশরা বিবি আগের স্বামী থেকে তালাক নেওয়ার পর ইদ্দত শেষ হওয়ার আগেই ইমরান খান ও তিনি বিয়ে করেছিলেন, এই অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। গত জুলাইয়ে তাঁরা এই মামলা থেকে খালাস পান।
ইমরান খান বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁর বিরুদ্ধে এসব মামলা করা হয়েছে।
ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে কী বললেন উজমা খান
পেশায় চিকিৎসক উজমা খান গত মঙ্গলবার ইমরান খানের সঙ্গে কারাগারে দেখা করার পর রাওয়ালপিণ্ডিতে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর ভাইকে দিনের বেশির ভাগ সময় কারাকক্ষে বন্দী রাখা হয়। খুব অল্প সময়ের জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
উজমা খান বলেন, তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। তবে তাঁকে সারাক্ষণ ঘরের ভেতরে রাখা হয়। অল্প সময়ের জন্য বাইরে বের করা হয়। কারও সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। তিনি খুব রেগে ছিলেন এবং বলেছিলেন, তাঁকে মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে।
উজমা খান আরও বলেন, কড়া নজরদারির মধ্যে ভাইয়ের সঙ্গে ৩০ মিনিট কথা বলেছেন তিনি। কোনো মুঠোফোন ফোন নিতে দেওয়া হয়নি।
ইমরান খানের আরেক বোন আলিমা খান ও পিটিআইয়ের নেতাদের সঙ্গে থাকা উজমা পরে আরও বলেন, ‘যখন দেখা হলো, তিনি খুব বিচলিত ও ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁকে ও বুশরা বিবিকে ছোট ঘরে অত্যন্ত মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রাখা হয়েছে। চার সপ্তাহ ধরে কারও সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি... এই মানসিক নির্যাতন শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও খারাপ।’
ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ কি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ
ইমরান খানের সঙ্গে কারও সাক্ষাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কি না, করা হলে এর পেছনে কারণ কী, তা নিশ্চিত করেনি পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ।
আদালতের অনুমতির পরেও ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না, পরিবারের সদস্য ও পিটিআই নেতারা এমন অভিযোগ করার পর গত মঙ্গলবারের সাক্ষাৎটি ঘটল। তাঁর বোনেদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়।
গত অক্টোবরের শেষের দিকে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট (আইএইচসি) আদিয়ালা জেলের সুপারিনটেনডেন্টকে মার্চ মাসে জারি করা একটি আদেশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশে প্রতি মঙ্গলবার এবং বৃহস্পতিবার ইমরান খানকে নির্দিষ্ট সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
তবে এই অনুমতি কখনোই কার্যকর করা হয়নি বলে অভিযোগ পরিবারের সদস্যদের। এর ফলে ইমরান খানের সমর্থকদের মধ্যে গুজব ছড়াতে শুরু করে যে, তিনি অসুস্থ বা তাঁকে অন্য কারাগারে স্থানান্তর করা হচ্ছে। এমনকি ইমরান খান মারা গেছেন বলেও ধারণা করেছিলেন কেউ কেউ।
সরকার কী বলেছে?
সরকার স্পষ্টভাবে নিশ্চিত করেনি যে, ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ বন্ধ করা হয়েছিল কি না। করা হলে এর পেছনে কোনো কারণ আছে কি না, তা–ও বলা হয়নি।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগের (পিএমএল-এন) রাজনীতিবিদ তারিক ফজল চৌধুরী ২৮ নভেম্বর জাতীয় পরিষদে বলেছিলেন, ইমরান খান ভালো আছেন। ভারতীয় ও আফগান সংবাদমাধ্যম তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে গুজব ছড়িয়েছে।
কেন ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় তুলেছে?
কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, কারাবন্দী ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করতে বাধা দেওয়া একটি রাজনৈতিক কৌশল, যা পাকিস্তানের শাসক দল পিএমএল (এন)-এর জন্য বুমেরাং হতে পারে।
ইসলামাবাদভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (সিআরএসএস) নির্বাহী পরিচালক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইমতিয়াজ গুল আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘প্রবেশাধিকার বন্ধ করা এবং খানকে নির্জন কারাবাসে রাখার প্রাথমিক উদ্দেশ্য মনে হয়, তাঁকে একটি সমঝোতায় আসতে বাধ্য করা এবং ব্যাপক সরকারবিরোধী মনোভাবকে প্রশমিত করা।’
ইমরান খানের দল পিটিআইকে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয়নি। দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দলের সদস্যরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং অন্য যেকোনো দলের চেয়ে বেশি আসন জিতেছিলেন।
কিন্তু পিটিআই অভিযোগ করেছিল যে, সরকার এবং সামরিক বাহিনী নির্বাচন কারচুপি করেছে, যাতে তারা আরও বেশি আসন না পায়। স্বাধীন পর্যবেক্ষকরাও ভোট গণনায় বেশ কয়েকটি অনিয়মের কথা বলেছিলেন।