ট্রাম্পের শুল্কের তোপে সির কাছে মোদি, কোন হিসাব কষে এগোচ্ছেন তাঁরা
চীনে আজ সোমবার দুই দিনব্যাপী সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলন শেষ হচ্ছে। এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এমন সময় তিনি চীন সফর করছেন, যখন তাঁর সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপিয়ে দেওয়া শুল্ক।
হীরা ও চিংড়ির মতো ভারতের বিভিন্ন পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্ক বেড়ে ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত বুধবার থেকে এ শুল্ক কার্যকর হয়েছে। ট্রাম্পের ভাষ্য অনুযায়ী, রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি অব্যাহত রেখেছে ভারত। এ জন্য ‘জরিমানা’ হিসেবে নয়াদিল্লির ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক আরোপের ফলে ভারতের রপ্তানি খাতের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ধাক্কা আসবে। নয়াদিল্লির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য রয়েছে, তাতেও আঘাত আসতে পারে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংও এমন একটা সময়ে নিজেদের অর্থনীতিকে চাঙা করার চেষ্টা করছেন, যখন আকাশছোঁয়া মার্কিন শুল্ক তাঁর পরিকল্পনাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দুই দেশের নেতা হয়তো নিজেদের সম্পর্ক নতুন করে শুরু করতে চাচ্ছেন। আগে এই সম্পর্ক অনাস্থায় ঘেরা ছিল। এর বড় কারণ ছিল সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের গবেষক চিয়েতিজ বাজপেয়ি ও ইউ জি বলেন, ‘সহজভাবে বলতে গেলে, এই সম্পর্কে যা হবে, তা বাকি বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
এই দুই গবেষকের ভাষ্য, ‘ভারত কখনোই চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ঢাল হয়ে উঠতে যাচ্ছিল না, যেমনটি পশ্চিমারা (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র) মনে করত...মোদির চীন সফর একটি সম্ভাব্য মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।’
২০২০ সালের জুনে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চীনের সেনাদের মধ্যে সংঘাত হয়েছিল। চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে এটি ছিল দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে দ্বন্দ্বপূর্ণ সময়।
ভারত–চীন শক্তিশালী সম্পর্কের অর্থ কী
ভারত ও চীন বড় অর্থনৈতিক শক্তির কেন্দ্র। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর তালিকায় চীন ও ভারতের অবস্থান যথাক্রমে দ্বিতীয় ও পঞ্চম।
তবে আগামী বছরগুলোয় ভারতের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপর থাকবে। ৪ লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতি ও ৫ লাখ কোটি ডলারের শেয়ারবাজার নিয়ে ২০২৮ সাল নাগাদ ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস এমনটিই বলছে।
বেইজিংভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উসাওয়া অ্যাডভাইজরির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কিয়ান লিউ বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক হলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক। চিরাচরিতভাবে বিশ্ব যখন এই সম্পর্কের ওপর মনোযোগ দিয়েছে, তখন সময় এসেছে বিশ্বের দ্বিতীয় ও সম্ভাব্য তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারত ও চীন কীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তার ওপর মনোযোগ দেওয়ার।
তবে এই সম্পর্কে বিরাট চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা অমীমাংসিত একটি আঞ্চলিক বিরোধ রয়েছে। এটি দুই পক্ষের মধ্যে আরও ব্যাপক ও গভীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঙ্গিত দেয়। ২০২০ সালের জুনে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত–চীনের সেনাদের মধ্যে সংঘাত হয়েছিল। চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে এটি ছিল দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে দ্বন্দ্বপূর্ণ সময়।
এর প্রভাবটা মূলত পড়েছিল অর্থনীতির ওপর। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছিল। ভিসা ও চীনা বিনিয়োগ স্থগিত করার ফলে অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর গতি কমে এসেছিল। আর টিকটকসহ চীনের দুই শতাধিক অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছিল নয়াদিল্লি।
সমস্যা এখানেই শেষ নয়। দুই দেশের সম্পর্কে দাগ কাটার মতো আরও কিছু বিষয় আছে। যেমন তিব্বত ও দালাই লামা ইস্যু। এ ছাড়া ভারত ও চীনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা একটি নদীর ওপর বেইজিং বিশ্বের সবচেয়ে বড় পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের যে পরিকল্পনা করছে, সেটি ঘিরে পানি নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। আছে সাম্প্রতিক সময়ে পেহেলগাম হামলার পর পাকিস্তান নিয়ে উত্তেজনা।
ভারতের নিজের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও বর্তমানে ভালো সম্পর্ক নেই। ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের একটি প্রধান বাণিজ্য অংশীদার চীন।
এমন পরিস্থিতিতে ভারত–চীন কাছাকাছি আসা নিয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এশিয়া ডিকোডের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান অর্থনীতিবিদ প্রিয়াঙ্কা কিশোর বলেন, চীনের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডির কোনো কারখানা যদি ভারতে নিয়ে আসা হয়, তাহলে তা হবে অবাক করার মতো। তবে এটি ছোটখাটো একটি সফলতা হতে পারে।
প্রিয়াঙ্কা বলেন, এরই মধ্যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট আবার চালু হচ্ছে। একই সঙ্গে ভিসা ও অন্যান্য বাণিজ্য চুক্তি নিয়েও আরও শিথিলতা আসতে পারে।
দুই দেশের সম্পর্কে যে জটিলতা রয়েছে, তাতে মোদি-সির একটি বৈঠকে বড় পরিবর্তন আসবে না। নয়াদিল্লি-বেইজিং সম্পর্ক এগিয়ে নিতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
ভারতের অবস্থান বদল
প্রিয়াঙ্কা কিশোর বলেন, তবে নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের সম্পর্ক নিঃসন্দেহে অস্বস্তিকর হবে। মনে রাখতে হবে, একসময় চীনকে একটি ভারসাম্যের মধ্যে আনতে কাছাকাছি এসেছিল ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির বর্তমান অবস্থান নিয়ে ভারত পুরোপুরি বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। তাই ভারত–চীনের কাছাকাছি আসাটা একটি সময়োচিত পদক্ষেপ।
মোদি যে এসসিও সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন, সেটি আঞ্চলিক একটি জোট। এর লক্ষ্য হলো পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির বিকল্প এক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। এর সদস্যদেশগুলোর মধ্যে রয়েছে—চীন, ভারত, ইরান, পাকিস্তান ও রাশিয়া। তবে অতীতে এসসিও নিয়ে কম গুরুত্ব দিয়েছে নয়াদিল্লি।
সমালোচকেরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে এই জোট থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো ফলাফল আসেনি।
গত জুনে এসসিওর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠক হয়েছিল। তবে সেখানে একটি যৌথ বিবৃতির বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর যে প্রাণঘাতী হামলা হয়েছিল, বৈঠকে তার কোনো উল্লেখ না থাকায় আপত্তি জানিয়েছিল ভারত। ওই হামলার জেরে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাতে জড়িয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কে মন্দার কারণে এসিওর প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বুঝতে পেরেছে নয়াদিল্লি। একইভাবে ট্রাম্পের চাপিয়ে দেওয়া শুল্ক নিয়ে বিশৃঙ্খলার মধ্যে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর মধ্যে সংহতিকেও মূল্যায়ন করবে চীন।
উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকসও ট্রাম্পের রোষানলে পড়েছে। এই জোটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চীন, ভারত, রাশিয়া, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। জোটের সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমঝোতা হয়েছে, তার ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
সবশেষ ২০২৪ সালের অক্টোবরে রাশিয়া অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে সি চিন পিং ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন মোদি। আর গত সপ্তাহে রাশিয়ার দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলেছেন, চীন ও ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করছে মস্কো।
ওয়াশিংনের প্রতি ভারতের বার্তা
রাশিয়া, চীন ও ভারত নিজেদের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারে বলে মনে করেন চ্যাথাম হাউসের গবেষক চিয়েতিজ বাজপেয়ি এবং ইউ জি। তাঁরা বলেন, চীন তাদের উৎপাদনক্ষমতা, ভারত সেবা খাতের শক্তি ও রাশিয়া প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে সম্মিলিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারে। তাদের রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আনতে পারে। আর শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবাহের নতুন রূপ দিতে পারে।
অর্থনীতিবিদ প্রিয়াঙ্কা কিশোর বলেন, চীন ও ভারতের মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারত্বের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি আরও ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনের আগ্রহ দেখাতে পারে। আর দ্রুত ভারতের ভিসার অনুমোদন চীনের জন্য সহজ বিজয় হতে পারে। হয় সরাসরি, না হয় বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে চায় বেইজিং। ভারতের প্রায় দেড় শ কোটির মানুষের কাছে নিজেদের পণ্য বিক্রির সুযোগকে স্বাগত জানাবে তারা।
দুই দেশের সম্পর্কে যে জটিলতা রয়েছে, তাতে মোদি–সির একটি বৈঠকে হয়তো বড় পরিবর্তন আসবে না। নয়াদিল্লি–বেইজিং সম্পর্ক এগিয়ে নিতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। তবে মোদির চীন সফরে দুই দেশের মধ্যে কিছু দ্বন্দ্ব মিটতে পারে। একই সঙ্গে এটি ওয়াশিংটনের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা যে ভারতের কাছে বিকল্প পথ আছে।