ব্রিটিশ রাজতন্ত্রই নয়, অস্থিরতা আছে অন্য রাজপরিবারগুলোতেও

একটি বইয়ের দোকানে হ্যারির লেখা স্মৃতিকথা ‘স্পেয়ার’–এর কিছু কপি সাজিয়ে রাখা হয়েছেছবি: এএফপি ফাইল ছবি

ব্রিটিশ রাজপরিবার তথা হাউস অব উইন্ডসরে অভ্যন্তরীণ ঐক্য ক্ষুণ্ন করা কিংবা বিশৃঙ্খলামূলক কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তবে বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লসের ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারির একটি বইয়ের বদৌলতে রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কথা এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। রাজপরিবার ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী হ্যারি তাঁর ‘স্পেয়ার’ নামক স্মৃতিকথায় ব্রিটেনের রাজপরিবারের নানা গোপন কথা সামনে এনেছেন। বড় ভাই ও বাবার সঙ্গে দ্বন্দ্ব, রাজপরিবারের অভ্যন্তরে বর্ণবাদের চিত্রসহ বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয় প্রকাশ করেছেন তিনি।

শুধু ব্রিটিশ রাজতন্ত্রই নয়, বিশ্বের আরও কিছু রাজপরিবারেও গত কয়েক বছরে অভ্যন্তরীণ অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা ও নাটকীয়তা দেখা গেছে। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় রাজ–উপাধি ছেড়ে দিয়েছেন, আবার কারও রাজ উপাধি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টাও দেখা গেছে কোথাও কোথাও।

ডেনমার্কের রানি দ্বিতীয় মারগ্রেথ
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

ডেনমার্কের রাজপরিবার
গত বছর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ডেনমার্কের রানি দ্বিতীয় মারগ্রেথ ঘোষণা করেন, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তিনি তাঁর দ্বিতীয় পুত্র প্রিন্স জোয়াকিমের চার সন্তানের রাজ–উপাধি প্রত্যাহার করছেন। নিকোলাই (২৩), ফেলিক্স (২০), হেনরিক এবং অ্যাথেনা (১০) নামে তাঁর চার নাতি–নাতনি এখন থেকে আর রাজপুত্র বা রাজকন্যা বলে বিবেচিত হবেন না। তাঁদের ডাকা হবে হিজ এক্সিলেন্সি কাউন্ট অব মনপেজাত কিংবা হার এক্সিলেন্সি কাউন্টেস অব মনপেজাত নামে।

রানি মারগ্রেথ তখন আরও বলেছিলেন, এ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাঁর চার নাতি–নাতনি রাজপদবির ছায়া ছাড়াই আরও বড় পরিসরে নিজেদের জীবন এগিয়ে নিতে পারবে।

রাজপুত্র জোয়াকিম ড্যানিশ ট্যাবলয়েড এক্সত্রা ব্লাদেতকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা সবাই খুব দুঃখ পেয়েছি। নিজের সন্তানদের সঙ্গে বাজে আচরণ হতে দেখাটা মজার কিছু নয়। তাদের এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে ফেলা হয়েছে, যা তারা বুঝতে পারে না।’

জোয়াকিম বলেন, সন্তানদের কথাটি জানানোর জন্য তাঁকে মাত্র পাঁচ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। তাঁর বড় ছেলে নিকোলাই বলেন, ‘আমরা এ সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছি। কেন এমন ঘটনা ঘটতে হলো, তা নিয়ে আমি বেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে আছি।’

গত অক্টোবরে রানি দ্বিতীয় মারগ্রেথ এ নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। রানি স্বীকার করেন, তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের প্রভাব কী হতে পারে, সেটিকে উপেক্ষা করেছেন। তবে অনেক দিন ধরেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছিল। মারগ্রেথের দাবি, রানি, মা এবং দাদি হিসেবে তাঁর যে মূল্যবোধ, তার সঙ্গে সংগতি রেখে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এক বিবৃতিতে মারগ্রেথ বলেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজতন্ত্রকে ঢেলে সাজাতে চান তিনি। এটাকে দায়িত্ব বলেও মনে করেন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, মাঝেমধ্যে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর এর জন্য সঠিক সময় খুঁজে বের করাটা সব সময়ই কঠিন।

নরওয়ের রাজপরিবার
গত নভেম্বরে নরওয়ের রাজকন্যা মার্থা লুইস রাজদায়িত্ব ছেড়ে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। হবু স্বামী ডুরেক ভেরেটের সঙ্গে যৌথভাবে বিকল্প ওষুধের ব্যবসার প্রতি মনোযোগ দিতে রাজদায়িত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি। তিনি এই ব্যবসার কাজে মন দিতে চান। ডুরেক একজন জনপ্রিয় তান্ত্রিক। ক্যানসারসহ চিকিৎসাক্ষেত্রের নানা বিষয় নিয়ে তিনি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।

নরওয়ের রয়্যাল হাউস থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাজকুমারী মার্থা লুইস বিকল্প ওষুধ ব্যবসায় মনোনিবেশ করবেন। এ কারণে রাজপরিবারের সরকারি দায়িত্ব ও তাঁর ব্যক্তিগত দায়িত্বের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করতে মার্থা রাজদায়িত্ব ত্যাগ করেছেন।

মার্থা লুইস হলেন রাজা পঞ্চম হ্যারাল্ড ও রানি সোনজার একমাত্র মেয়ে। রাজা পঞ্চম হ্যারল্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মার্থা রাজদায়িত্ব ছাড়লেও তাঁর রাজ-উপাধি আগের মতোই থাকবে। এ ছাড়া তিনি রাজপরিবারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবেন।

থাই রাজা মহা ভাজিরালংকর্ন
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

থাইল্যান্ডের রাজা মহা ভাজিরালংকর্ন
থাই রাজা মহা ভাজিরালংকর্ন গতানুগতিক রাজাদের মতন নন। সিংহাসনে আসীন অবস্থায়ই নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সমালোচিত তিনি। বাবার মৃত্যুর আড়াই বছর পর ২০১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনে আরোহণ করেন থাই রাজা মহা ভাজিরালংকর্ন।

মহা ভাজিরালংকর্ন চারটি বিয়ে করেছেন। এ ছাড়া আরও অনেক নারীর সঙ্গে তাঁর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থাকার বিষয়টিও বেশ প্রকাশ্য।

মহা ভাজিরালংকর্ন যখন যুবরাজ ছিলেন, তখন তাঁর পোষা কুকুর ফু ফুকে এয়ার ভাইস মার্শাল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। শুধু তা–ই নয়, ২০১৫ সালে কুকুরটি মারা যাওয়ার পর বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী চার দিন ধরে তার শেষকৃত্য হয়েছে।

৭০ বছর বয়সী রাজা ভাজিরালংকর্ন হাতাকাটা গেঞ্জি পরতে ভালোবাসেন। এ পোশাকে পেটের অংশ ফাঁকা থাকে। তিনি বিভিন্ন ট্যাটুও পরতেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় থাইল্যান্ডে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের এ ধরনের পেট খোলা পোশাক পরে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে দেখা গেছে। তাঁদের দাবি, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এ রাজার ক্ষমতা যেন সীমিত করা হয়।

তবে থাইল্যান্ডে রাজার বিরুদ্ধে কেউ অপমান ও সমালোচনা করলে আইনে তাঁকে ১৫ বছরের জেল শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে।

স্পেনের রাজপরিবার
প্রায় চার দশক ধরে স্পেনের রাজা ছিলেন হুয়ান কার্লোস। ২০১৪ সালে ছেলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। ২০২০ সালে জালিয়াতিসংক্রান্ত তদন্তকারীরা অভিযোগ করেন, সৌদি আরবের সঙ্গে উচ্চগতির ট্রেনসংক্রান্ত এক চুক্তির জন্য ঘুষ হিসেবে প্রায় ১০ কোটি ডলার পেয়েছেন তিনি। ৬০০ কোটি ডলার মূল্যের ওই রেল প্রকল্পের কাজটি পেয়েছিল স্পেনের একটি কোম্পানি।

হুয়ান কার্লোস যতক্ষণ রাজা ছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর দায়মুক্তি ছিল। ২০১৪ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর সৌদি প্রকল্পের সঙ্গে হুয়ান কার্লোসের দুনীতির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের উদ্যোগ নেয় দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। এই তদন্ত সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতেও গড়িয়েছিল। কারণ, স্পেনের দুর্নীতিবিরোধী কর্মকর্তারা সন্দেহ করেন, সাবেক এই রাজার কিছু অঘোষিত অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে গচ্ছিত আছে। অবশ্য সুইশ কৌঁসুলিরা মামলাটি খারিজ করে দেন।

আরও পড়ুন

তবে ২০২০ সালে দেশের অভ্যন্তরীণ তদন্তের তথ্য প্রকাশের পর হুয়ান কার্লোস আবুধাবিতে চলে যান। স্পেনের রাজসিংহাসনে আসীন হন হুয়ান কার্লোসের ছেলে ফেলিপ। গত বছরের মে মাসে স্পেনের সাবেক রাজা হুয়ান কার্লোস প্রায় দুই বছর পর নিজ দেশে ফেরেন।

তবে এটিই প্রথম নয়। বিলাসী জীবনযাপনের জন্য এর আগেও বিভিন্ন সময়ে হুয়ান কার্লোস সমালোচনার স্বীকার হয়েছেন। এর মধ্যে আছে দেশে অর্থনৈতিক সংকট চলার মধ্যে হাতি শিকার এবং বেশ কয়েকটি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ঘটনা। এ ছাড়া ব্যবসায়িক লেনদেনে অস্বচ্ছতা থাকায় স্প্যানিশ রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে। কার্লোসের জামাতার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির তদন্ত হয়েছে। বর্তমান রাজা ফেলিপ, তাঁর স্ত্রী রানি লেতিজিয়া এবং তাঁদের দুই সন্তান জনগণের কাছে পুরোনো ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জর্ডানের রাজপরিবার
জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহর সৎভাই হামজা। ২০০৪ সালে হামজাকে জর্ডানের যুবরাজের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মূলত, তার পর থেকেই রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্যের শুরু। তিনি জর্ডানের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও হয়রানির অভিযোগ তুলে আসছিলেন। ২০২১ সালের এপ্রিলের শুরুর দিকে জর্ডানের উপপ্রধানমন্ত্রী আয়মান সাফাদি অভিযোগ করেন, জর্ডানকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেশটির সাবেক যুবরাজ হামজা বিদেশিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার কথাও জানান তিনি।

রাজতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টার অভিযোগে  ওই বছরের জুলাইয়ে জর্ডানের একটি সামরিক আদালত রাজপরিবারের দুই সাবেক সদস্যকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেন। রাজপরিবারের সাবেক এক অপ্রাপ্তবয়স্ক সদস্যকেও একই দণ্ড দিয়েছেন আদালত।

আরও পড়ুন

রায়ে বিচারক বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনা রাজতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁরা দুজন রাজতন্ত্র তথা রাজপরিবারকে অস্থিতিশীল করতে বাদশাহর বিকল্প হিসেবে প্রিন্স হামজাকে ক্ষমতায় বসানোর পাঁয়তারা করেছিলেন।

অভিযোগের জেরে হামজাকে আর বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। ২০২১ সালের এপ্রিলে বাদশার প্রতি আনুগত্য স্বীকারের কারণে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। জর্ডানের কর্তৃপক্ষ পরে জানায়, হামজার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি রাজপরিবারের ভেতরই পারিবারিকভাবে সুরাহা করা হয়েছে।

জাপানের রাজকুমারী মাকো
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

জাপানের রাজপরিবার
২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর রাজকীয় মর্যাদা ছেড়ে জাপানের রাজকুমারী মাকো তাঁর সাবেক সহপাঠী কুমোরোকে বিয়ে করেন। কুমোরো রাজপরিবারের সদস্য নন। তিনি একজন সাধারণ আইনজীবী। কুমোরোকে বিয়ে করার জন্য রাজকন্যা মাকোকে রাজকীয় মর্যাদা হারাতে হয়। জাপানি আইন অনুসারে, রাজপরিবারের কোনো নারী যদি বাইরের সাধারণ কাউকে বিয়ে করেন, তাহলে তিনি রাজকীয় মর্যাদা হারান। তবে পুরুষ সদস্যের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়।

মাকোর রাজপদবি হারানোর পর ঐতিহ্য অনুযায়ী ১৩ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ১১৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা) পাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি এই পারিবারিক অর্থ নিতে অস্বীকৃতি জানান। জাপানি রাজপরিবারের তিনিই প্রথম ও একমাত্র সদস্য, যিনি পদ–পদবি, অর্থ ত্যাগসহ পুরোপুরি রাজকীয় সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন।


নিউইয়র্ক টাইমস, রয়টার্স, বিবিসি, পিপল অবলম্বনে ফাহমিদা আক্তার