বাইডেনের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ

  • আসছে সপ্তাহে ওয়াশিংটন উত্তপ্ত হয়ে উঠবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের পরিকাঠামো আইন প্রস্তাব নিয়ে।

  • আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তুত মঞ্চের শেষ দৃশ্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিউইয়র্কে বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন শেষে বক্তব্য দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ৭ সেপ্টেম্বর, কুইন্স বরো
ছবি: রয়টার্স

একের পর এক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আসন্ন কিছু সমস্যা মোকাবিলার দক্ষতার ওপরই এখন নির্ভর করছে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। আগামী বছরের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের ভরাডুবি ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আসন্ন সব রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

না হলে যুক্তরাষ্ট্রের নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে মার্কিন রাজনীতির ইতিহাস কীভাবে দেখবে—এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় তাঁর একান্ত অনুরাগীরাও।

একের পর এক রাজনৈতিক বৈরিতা ও সমস্যা তাড়া করছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই এমন বহুমুখী সমস্যায় পড়তে হয়নি সাম্প্রতিক ইতিহাসের কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সমস্যা ও বৈরিতার পাহাড়ে নতুন পাথর যুক্ত হয়েছে।

করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা ছাড়াও অভিবাসন, সীমান্ত সমস্যা, প্রস্তাবিত পরিকাঠামো উন্নয়ন, জলবায়ুবান্ধব উন্নয়ন, চরমপন্থী রক্ষণশীলদের উত্থানসহ বাইরের জঙ্গিগোষ্ঠীর হুমকি এখন তাড়া করছে বাইডেনকে। নিজ দলের উদারনৈতিক পক্ষের সঙ্গে দেনদরবারের ফারাকটাও বেশ বড় হয়ে উঠেছে তাঁর জন্য। এর মধ্যে টেক্সাসে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার রায় দিয়েছেন। মার্কিন রাজনীতির উদারনৈতিক পক্ষের জন্য এ রায় চরম বার্তা নিয়ে এসেছে।

এরপরও মার্কিন রাজনীতিতে অভিজ্ঞ নেতা জো বাইডেন ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন, এ কথাই বিশ্বাস করেন তাঁর সমর্থকেরা। অর্ধ শতাব্দীর রাজনৈতিক জীবনে একজন জো বাইডেন অতীতে বারবার বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে কীভাবে তিনি ঘুরে দাঁড়াবেন, তা দেখা যাবে আসছে মাসগুলোতে।

আসছে সপ্তাহেই ওয়াশিংটন উত্তপ্ত হয়ে উঠবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের পরিকাঠামো আইন প্রস্তাব নিয়ে। অনেকেই মনে করেন, এ আইন প্রস্তাব পাস হলে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দাবি করতে পারবেন, গত ৫০ বছরে কোনো ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট যা করতে পারেননি, তা তিনি করেছেন। সাড়ে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের পরিকাঠামো বিলের অর্থ ব্যয় সাজানো হয়েছে পুরো একটি রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিকল্পনার মাধ্যমে। এ আইন পাস হলে যুক্তরাষ্ট্রের অবকাঠামোই শুধু পরিবর্তন হবে এমন নয়, সামাজিক নানা খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। সামাজিক নিরাপত্তা, অভিবাসন, জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলাসহ নানা উদারনৈতিক পরিকল্পনার জন্য বিপুল বরাদ্দ রয়েছে এ অর্থ প্রস্তাবে। পুরো পরিকল্পনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মজীবী মধ্যবিত্তকে প্রাধান্য দিয়ে সাজানো হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চবিত্তের লোকজন এখন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পেছনে। মার্কিন সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলো এঁরাই নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এঁদের বিরোধিতা মোকাবিলা করে সাড়ে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের পরিকাঠামো আইন পাস করতে সক্ষম হলেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে বলে অনেকেই মনে করেন।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেও ৩ সেপ্টেম্বর বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র নির্মাণ করেছে এ দেশের কর্মজীবীরা। এখন সময় এসেছে উচ্চবিত্তদের সমাজে তাঁদের ন্যায্য প্রদেয় নিশ্চিত করার। এ কাজটি দৃঢ়তার সঙ্গে করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

এ কাজের মধ্যেও রাজনৈতিক ঝুঁকি দেখছেন অনেক বিশ্লেষক। আগামী বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলকে প্রতিনিধি পরিষদে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে হতে পারে। আবার প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে রিপাবলিকান দলকে আরেক দফা ঠেকাতে পারলে মার্কিন রাজনীতিতে আবারও বীরত্বের উপাধি নির্ধারিত হয়ে থাকবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য।

বিদেশ নীতিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে একজন দক্ষ রাজনীতিক হিসেবে দেখে আসা হচ্ছিল সর্বমহলে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছেও তাঁর বার্তা ছিল আমেরিকা ফিরে এসেছে বলে। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তুত মঞ্চের শেষ দৃশ্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিত্র শক্তির কাছেও সমালোচিত হচ্ছেন ব্যাপকভাবে। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং মার্কিন লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে আনার বিপর্যয়ের কালিমা থেকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কী করে ঘুরে দাঁড়াবেন, তাঁর নিজের দলের নেতারাও তা জানেন না। এর মধ্যে বাইরের জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনাকর অবস্থান এখন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘নাইন-ইলেভেন’ ঘটনার ২০ বছর পূর্তির সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আবারও জঙ্গি হামলা নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দারা সতর্ক থাকলেও উৎকণ্ঠা তাড়া করছে। বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে সরে আসার শেষ সপ্তাহে আইএস জঙ্গিদের হামলায় নিহত মার্কিন ১৩ জন সৈন্যের পতাকা মোড়ানো কফিন মার্কিনিদের তাড়া করছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলে দিয়েছেন, ঘটনার জন্য দায় স্বীকার করা আইএস-কে নামের জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের খেলা শেষ হয়ে যায়নি।

হোয়াইট হাউস আফগানিস্তান ইস্যুকে ভুলে গিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে জোর দেওয়াকেই এখন সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যতই আফগান পরিস্থিতিকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, ততই মার্কিন রক্ষণশীলরা এ বিষয়কে সামনে নিয়ে আসছেন। নেব্রাস্কা থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর বেন সাসি বলেছেন, এখনো আফগানিস্তানে তালেবান এবং আইএসের হাত থেকে পালিয়ে থাকা মার্কিনদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বিকারহীন।

আফগানিস্তান থেকে অবশিষ্ট মার্কিনদের এখনো নিরাপদে সরিয়ে আনা এবং মার্কিন সাহায্যকারী আফগানদের যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন দেওয়ার বিতর্ক থেকে বাইডেন প্রশাসন সরে আসতে পারছে না। সহসা এ বিতর্ক ও সমালোচনা চাপা দেওয়া যাবে, এমন মনে করারও কোনো কারণ নেই।

টেক্সাস রাজ্যে প্রণীত গর্ভপাতবিরোধী আইন মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করতে পারেননি। এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব নিয়ে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। গর্ভপাত বিতর্ক মার্কিন রাজনীতির দীর্ঘকালীন চলমান বিতর্ক। গর্ভপাতকে অবৈধ ঘোষণা করে টেক্সাসে প্রণয়ন করা আইন সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে ঠেকাতে না পারার কারণে এর ঢেউ পড়বে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে। নতুন করে চাঙা হওয়া গর্ভপাতবিরোধী আইন বিতর্কে রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মার্কিন সমাজ জীবনে রক্ষণশীল ধারণার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে গর্ভপাতবিরোধী আইন পাস হওয়ার ফলে, এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

এখনো মহামারি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। ১৮ মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমণে সাড়ে ছয় লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে এখনো প্রতিদিন দেড় লাখ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। গড়ে ১৫০০ লোকের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন। মহামারি মোকাবিলার জন্য টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা এখনো অর্জিত হয়নি।

সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা ত্যাগের সময়ে টিকাদান শুরু হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট বাইডেন আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন গত ৪ জুলাইয়ের মধ্যে দেশের বেশির ভাগ মানুষকে টিকা প্রদান করে বিজয় উদ্‌যাপন করবেন। সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এখন বুস্টার ডোজের বিতরণ শুরু হয়েছে। মহামারি নিয়ন্ত্রণ না করে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে না আনার ব্যর্থতাও এখন উচ্চারিত হতে শুরু করেছে।

১৮ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন ডিসিতে আবারও ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকেরা সমাবেশের ডাক দিয়েছে। গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় জেলে যাওয়া লোকজনের মুক্তির দাবিতে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। চিহ্নিত রক্ষণশীলরা আবার ওয়াশিংটনে সভা করায় সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এসব বহুমুখী সমস্যা ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসনামল কীভাবে চিহ্নিত হবে, তা দেখার জন্য সামনের মাসগুলো খুবই গুরুত্বের বলে মনে করছেন মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।