যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা স্থগিতে বিপদে ইউক্রেন

  • ইউক্রেনের পথে থাকা মার্কিন অস্ত্র ফেরত আনা হবে।

  • যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে ইউক্রেনকে রক্ষায় দ্বিগুণ অর্থসহায়তা দিতে হবে ইউরোপকে।

  • ইউরোপের প্রতিরক্ষায় ৮০০ বিলিয়ন পাউন্ডের তহবিল গঠনের পরিকল্পনা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনায় ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশিক্ষণ দেখছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। জার্মানির একটি অজ্ঞাত স্থানে; ১১ জুন ২০২৪ছবি: রয়টার্স

হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভলোদিমির জেলেনস্কির নজিরবিহীন বিতণ্ডার পর ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের সামরিক সহায়তা স্থগিত হতে পারে—এমন আশঙ্কা ছিল। অবশেষে তা সত্যি হলো। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউক্রেনে আপাতত কোনো সামরিক সহায়তা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। একই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা শিথিলের পরিকল্পনা করছে তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের পর গতকাল মঙ্গলবার জেলেনস্কি এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ইউক্রেনে টেকসই শান্তির লক্ষ্যে তিনি ট্রাম্পের শক্তিশালী নেতৃত্বে কাজ করতে চান। ওয়াশিংটনের সঙ্গে খনিজ চুক্তি করতেও প্রস্তুত আছেন।

তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৬৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা পেয়েছে ইউক্রেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই সহায়তা দিয়েছিলেন। গত ডিসেম্বরে ক্ষমতা ছাড়ার আগে কিয়েভের জন্য আরও ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র, সামরিক যান ও অন্যান্য সরঞ্জাম অনুমোদন দেন বাইডেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন মূলত সেই অস্ত্র ও সরঞ্জামগুলোর চালান স্থগিত করেছে। প্রশাসনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে বলেছেন, অস্ত্রগুলোর চালান পুরোপুরি বন্ধ করা হয়নি, সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।

আর ব্লুমবার্গের খবরে বলা হয়েছে, পুরোনো চালানের যেসব অস্ত্র ইউক্রেনে যাচ্ছিল, তার সবই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা হবে। যেসব অস্ত্র এরই মধ্যে সরবরাহের জন্য উড়োজাহাজে তোলা হয়েছে এবং পোল্যান্ডের ট্রানজিট এলাকায় জাহাজে মজুত রয়েছে, সেগুলোও ফেরত আনা হবে।

অস্ত্রের এই চালান স্থগিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথকে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প। ওই নির্দেশের পর হেগসেথের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড ও ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ। এরপর ইউক্রেনে অস্ত্রসহায়তা স্থগিত করার পাকা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এর আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেন ট্রাম্প ও জেলেনস্কি। আলোচনার এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। এরপর জেলেনস্কি ও তাঁর দলকে ওভাল অফিস ছেড়ে যেতে বলেন মার্কিন কর্মকর্তারা। সেদিন দুই দেশের মধ্যে খনিজ সম্পদবিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

আরও পড়ুন

ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করতে চান জেলেনস্কি

ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে জেলেনস্কি গতকাল এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ইউক্রেনে টেকসই শান্তির জন্য তিনি ও তাঁর দল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শক্তিশালী নেতৃত্বের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর বৈঠক যেভাবে এগোনোর কথা, সেভাবে এগোয়নি। এটা ঠিক করার এখনই সময়।

জেলেনস্কি আরও লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে চুক্তি করতে প্রস্তুত কিয়েভ। যেকোনো সময় ও যেকোনো উপযুক্ত কাঠামোয় সেই চুক্তি করতে রাজি ইউক্রেন।

আরও পড়ুন

‘ইউক্রেনকে আত্মসমর্পণের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন ট্রাম্প’

এর আগে মার্কিন সামরিক সহায়তা স্থগিতের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ইউক্রেন। জেলেনস্কির এক্স বার্তার আগে ইউক্রেনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রি জাগোরোদনিয়ুক বলেন, মস্কোর পাশবিক শর্তের ভিত্তিতে তৈরি একটি খারাপ শান্তিচুক্তি মেনে নিতে ভলোদিমির জেলেনস্কির ওপর জোর খাটাচ্ছে হোয়াইট হাউস। কিয়েভ যদি এই চুক্তিতে রাজি না হয়, তাহলে মার্কিন সামরিক সহায়তা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

ট্রাম্প ইউক্রেনকে আত্মসমর্পণের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন বলে মনে করেন ইউক্রেনের পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির প্রধান ওলেকসান্দ্র মেরেঝকো। তিনি বলেন, এখন অস্ত্রসহায়তা বন্ধের অর্থ হলো রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সহায়তা করা। ট্রাম্প ইউক্রেনকে রাশিয়ার দাবিগুলো মেনে নেওয়ার চাপ দিচ্ছেন।

পরিখায় বিশ্রাম নেওয়ার সময় কফি বানাচ্ছেন ইউক্রেনের ২৪তম সাঁজায়ো ব্রিগেডের এক সদস্য। দোনেৎস্ক অঞ্চলের চাসিভ ইয়ার এলাকায়; ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ছবি: রয়টার্স

এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপের প্রতিরক্ষা খাতকে শক্তিশালী করতে এবং সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে প্রায় ৮০০ বিলিয়ন পাউন্ডের একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন। গতকাল ব্রাসেলসে ‘ইউরোপকে নতুন করে অস্ত্র সজ্জিতকরণ’ নামের পরিকল্পনা সম্পর্কে উরসুলা বলেন, ‘এটি ইউরোপের সময়। আমরা সামনে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।’

আরও পড়ুন

নিষেধাজ্ঞা শিথিলের পরিকল্পনা

রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে একটি পরিকল্পনা তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক আবার চালু এবং ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি চাওয়ায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা এবং বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এক ব্যক্তি জানিয়েছেন।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে মস্কোর সঙ্গে বড় পরিসরে আলোচনা শুরু করতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন। তার অংশ হিসেবে আগামী দিনগুলোতে মার্কিন কর্মকর্তারা যেন রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারেন, সেই পরিবেশ তৈরি করতে যেসব নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা যায়, সেগুলোর একটি তালিকা তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছে হোয়াইট হাউস।

ক্রেমলিন গত বছর জো বাইডেন প্রশাসনের অধীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ‘শূন্যের নিচে’ বলে উল্লেখ করেছিল। ডেমোক্র্যাট নেতা বাইডেন অস্ত্র ও অর্থসহায়তা দিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেনে অভিযান চালানোর শাস্তি হিসেবে বাইডেন প্রশাসন দেশটির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।

আরও পড়ুন

মার্কিন সহায়তার ঘাটতি কি ইউরোপ মেটাতে পারবে

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যেসব সমরাস্ত্র সরবরাহ করে এসেছে, সেগুলো ইউরোপ দেবে—এমন হিসাবনিকাশ বেশ কঠিন। লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক র‌্যাচেল এলেহুস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বিশেষ করে তিনটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো আকাশ প্রতিরক্ষা, যেখানে প্যাট্রিয়ট–ব্যবস্থার বিকল্প ইউরোপে তেমন একটা নেই; দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, এ ক্ষেত্রে জার্মানি তাদের টরাস ক্ষেপণাস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, আর ফ্রাঙ্কো–ব্রিটিশ স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে; এবং তৃতীয়ত, স্যাটেলাইট যোগাযোগ, যেখানে ইলন মাস্কের স্টারলিংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

এখানে যুদ্ধের ব্যয় চালানোর প্রশ্নও রয়েছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সহায়তার তুলনায় ইউরোপীয় দেশগুলোর সামরিক সহায়তা বেশি নয়। জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব কিয়েলের হিসাবমতে, ইউরোপের দেওয়া এই সহায়তার পরিমাণ ৬২ বিলিয়ন ইউরো, যা ৬৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। আর যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে দিয়েছে ৬৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার পর সেই অভাব পূরণ করতে ইউরোপকে দ্বিগুণ অর্থ ঢালতে হবে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন