আড়ালে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ ছিলেন জাওয়াহিরি

আয়মান আল–জাওয়াহিরি
এএফপি

আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল–জাওয়াহিরি সম্ভবত জীবনের শেষ সময়েও এমনটাই ভাবছিলেন যে তিনি তাঁর জিহাদে জয়ী হয়েছেন। তাঁদের তালেবান মিত্ররা এক বছর আগেই আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছে। রাজধানী কাবুলকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক বাহিনীকে গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে। আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরি নিশ্চিতভাবেই এটা আশা করেছিলেন, কয়েক দশকের দৌড়ঝাঁপ শেষে তিনি এখন নিরাপদ।

তবে জাওয়াহিরি যখন তাঁর কাবুলের অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় বেরিয়ে এলেন, হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র তখন তাঁকে নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হলো এবং ক্ষমাহীনভাবে আঘাত হানল। ওসামা বিন লাদেনের চেয়ে ১১ বছর বেশি বেঁচে থাকতে পেরেছিলেন জাওয়াহিরি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকেও প্রাণ খোয়াতে হলো। আর যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের পক্ষে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলতে পারলেন, ‘যত সময়ই লাগুক, যেখানেই লুকিয়ে থাকো, যদি তুমি আমাদের জনগণের জন্য হুমকি হও, তবে যুক্তরাষ্ট্র তোমাকে খুঁজে বের করবেই।’

জাওয়াহিরি নিঃসন্দেহে একজন কঠোর মানুষ ছিলেন। শত্রুর প্রতি ঘৃণা ও শক্রকে শায়েস্তা করার বাসনা থেকে তিনি তাঁর প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সব সময় সচেষ্ট ছিলেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে ‘ওয়াশিংটনের কসাই’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সেই যুদ্ধে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কিছু বিপর্যয়কর ভুল করেছে। একটি দেশ হিসেবে, সামরিক শক্তি হিসেবে তারা মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। মুসলিম–অধ্যুষিত ভূমিতে যেভাবে সামরিক বাহিনী পাঠানো হয়েছে, জাওয়াহিরি ও বিন লাদেন হয়তো তেমনটাই আশা করেছিলেন। তবে নয়-এগারোর হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং ওই সন্ত্রাসী হামলার ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে মূল সন্ত্রাসবাদবিরোধী যে অভিযান, সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র এতটুকু নড়েনি; দৃষ্টি সঠিক দিকে নিবদ্ধ রেখে এগিয়েছে।
ওসামা বিন লাদেনের মতো ভয়ংকর নাটকীয় ঘটনা ঘটানোর সক্ষমতা জাওয়াহিরির ছিল না। তবে তর্জন-গর্জনের ক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত ছিলেন আদর্শ ব্যক্তি, যা আল-কায়েদাকে ফুঁসে ওঠার জ্বালানি জোগাত।

যেখানে ওসামা বিন লাদেন ছিলেন রোগাপাতলা, একজন চোস্ত শেখ; এর বিপরীতে চশমা পরা চিকিৎসক জাওয়াহিরি ছিলেন অনেকটাই হৃষ্টপুষ্ট। মিসরে যে পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন, তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বিজ্ঞানী ও স্বনামখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত। এ কারণে তিনি আধুনিক প্রযুক্তি ও সপ্তম শতকের মূল্যবোধের সম্মিলন ঘটাতে পেরেছিলেন, যা আল-কায়দাকে রীতিমতো হামলার জন্য মুখিয়ে রাখত। মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক লরেন্স রাইট তাঁর চমৎকার গবেষণাভিত্তিক বই ‘দ্য লুমিং টাওয়ার’-এ দেখিয়েছেন, জাওয়াহিরির আত্মীয়স্বজনের মধ্যে চিকিৎসক, কেমিস্ট ও ফার্মাসিস্ট ছিলেন ৩১ জন।

আরও পড়ুন

ওসামা বিন লাদেন ছিলেন অভিজাত শ্রেণির একজন, কিন্তু জাওয়াহিরি ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। তাঁর মূল প্রোথিত ছিল মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের মধ্যে। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্ডারগ্রাউন্ড এ সংগঠনের বহু সদস্যকে কারাগারে পোরা হয়েছে, অত্যাচার করা হয়েছে। জাওয়াহিরির অনুপ্রেরণা ছিলেন ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা সাইদ কুতব, যিনি পশ্চিমা দেশগুলোকে দেখতেন জাগতিক প্রলোভনের ক্ষেত্র হিসেবে। এ জন্য পশ্চিমাদের প্রত্যাখ্যান ও ধ্বংস করা ‘ধার্মিক মুসলমান’ হিসেবে দায়িত্ব বলে মনে করতেন সাইদ কুতব।

লরেন্স রাইটের বইয়ের তথ্য বলছে, জাওয়াহিরি মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রথম গোপন আস্তানা গড়ে তুলেছিলেন। এ জন্য তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। কঠোর তদন্ত কর্মকর্তারা পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা অন্যদের তথ্য দিতে জাওয়াহিরিকে বাধ্য করেছিলেন। এই ‘অপমান’ ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে তিক্ত স্মৃতি।

আরও পড়ুন

জাওয়াহিরি নিঃসন্দেহে একজন কঠোর মানুষ ছিলেন। শত্রুর প্রতি ঘৃণা ও শক্রকে শায়েস্তা করার বাসনা থেকে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সব সময় সচেষ্ট ছিলেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে তিনি আখ্যায়িত করেছিলেন ‘ওয়াশিংটনের কসাই’। এমনকি উপহাস করে বলেছিলেন, ‘তুমি ব্যর্থ ও পরাজিত। তুমি তোমার জাতির জন্য ক্ষতিকর...ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে কারা পিছু হটছে, আমরা নাকি তোমরা?’ মার্কিন বিমান হামলাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর জাওয়াহিরি এসব কথা বলেছিলেন। পাকিস্তানের উপজাতি–অধ্যুষিত এলাকায় গোপনে আশ্রয় নিয়েছেন জাওয়াহিরি। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল মার্কিন বাহিনী।

পশ্চিমা ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের গণজাগরণ ঘটবে—এমনটা বিশ্বাস করতেন জাওয়াহিরি। তাঁর এ বিশ্বাসের প্রতিফলন তিনি দেখতে পেয়েছিলেন আরব বসন্তের মধ্যে। কায়রোর তাহরির স্কয়ারে যে গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল, যার ধাক্কায় পতন ঘটে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের, সেই অভ্যুত্থানকে নিজের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন জাওয়াহিরি। তিনি ওই সময় (২০১১ সালের মার্চ মাসে) একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন। মিসরীয় ওই অভ্যুত্থানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মৌন সম্মতি ছিল। মিসরীয় শাসকের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘দিকবদলকে’ টিটকারি করেছিলেন জাওয়াহিরি। বলেছিলেন, ‘৩০ বছর ধরে দুর্নীতির ব্যাপারে টুঁ শব্দটি করেনি যুক্তরাষ্ট্র, একইভাবে মোবারক, তাঁর পরিবার ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের দেশের সম্পদ তছরুপেও তারা মৌন থেকেছে।’

মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক লরেন্স রাইট তাঁর চমৎকার গবেষণাভিত্তিক বই ‘দ্য লুমিং টাওয়ার’-এ দেখিয়েছেন, জাওয়াহিরির আত্মীয়স্বজনের মধ্যে চিকিৎসক, কেমিস্ট ও ফার্মাসিস্ট ছিলেন ৩১ জন।

বন্দী থাকা, নির্যাতন সওয়া ও লুকিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে জীবন কাটানো একজন মানুষের স্বর ছিল জাওয়াহিরির, তাঁর কথাবার্তায় সেই ছাপ পড়ত। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত বা সহজাত নেতা ছিলেন না তিনি; তাঁর মধ্যে কারিশমারও ঘাটতি ছিল। এমনকি ওসামা বিন লাদেনের সম্পাদিত বিভিন্ন লেখাও (নোটস) খুব ম্যাড়মেড়ে, সেগুলোর মধ্যে প্রভাবিত করা মতো কিছু ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড ওই সব লেখা প্রকাশ করেছিল, যাতে ২০১১ সালের ইশতেহারের (জাওয়াহিরি ঘোষিত) একটা সংস্করণ ছিল।

শেষ পর্যন্ত জাওয়াহিরি কট্টর ব্যক্তিই ছিলেন। তিনি চাইতেন মার্কিন বাহিনী বিশ্বের যেখানেই মোতায়েন করা হোক না কেন, সেখানেই তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যেতে। যদিও নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে ঝুঁকি নেওয়ার ব্যাপারে ওসামা বিন লাদেন ছিলেন সংশয়ী; কিন্তু জাওয়াহিরি এ ক্ষেত্রে চরম কট্টর উত্তরসূরিদের চেয়েও অনেক এগিয়ে ছিলেন।

ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আল-কায়েদা অনেকটা আড়ালে পড়ে যায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কারণে। অতি আক্রমণাত্মক এই গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে নতুন ইসলামি খিলাফত গঠনে আগ্রহী হয়ে ওঠে—সেটা হোক সিরিয়া, ইরাক বা অন্য কোনোখানে। গ্রুপটির লক্ষ্য ছিল যেখানেই তারা নিজেদের দখল কায়েম করতে পারবে, সেখানেই দ্রুততার সঙ্গে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবে। এমনকি আফগানিস্তানের (যেখানে জাওয়াহিরি গোপনে আশ্রয় নিয়েছিলেন) ব্যাপারেও আইএস সমান উৎসাহী ছিল। ফলে আল-কায়েদার চেয়ে বেশি সামনে চলে আসে আইএস।

আরও পড়ুন

জাওয়াহিরি শেষ দশকে নিশ্চিতভাবেই এটা ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি একজন বিস্মৃত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু কথাটি অবশ্য পুরোপুরি সত্য নয়। কেননা, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সন্ত্রাসবাদবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের প্রতিদিনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়ে যারা সন্দিহান, হোক তারা রুশ, চীনা বা অন্য কেউ, তাদের জন্য এটা সতর্কবার্তা। মার্কিনদের হয়তো কিছুটা ধৈর্যহারা ও অনাস্থাভাজন মনে হতে পারে, কিন্তু তারা কোনো কিছু ভোলে না; তাদের স্মৃতিশক্তি প্রখর।
অনুবাদ হাসান ইমাম