হামাসের সঙ্গে প্রথমবারের মতো সরাসরি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, কী চায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনটি

ইসরায়েলের সঙ্গে সপ্তম দফায় জিম্মি বিনিময়ের জন্য জড়ো হয়েছেন হামাসের সদস্যরা। সেখানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে এসেছে শিশুরাও। মধ্য গাজার নুসরেইত শরণার্থীশিবির, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ছবি: এএফপি

গত ১৭ মাসের বেশির ভাগ সময় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের চেয়ে গাজা যুদ্ধের রাজনৈতিক সমাধানের ধারণাই বেশি আলোচিত হয়েছে। তবে এ ধারণাও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে বলে মনে করা হচ্ছে। ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক সামরিক অভিযানে গাজায় এরই মধ্যে প্রাণ গেছে প্রায় অর্ধলাখ মানুষের। সেই সঙ্গে চলেছে অনেক বাগাড়ম্বর।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সদস্যরা ‘দুর্বল হয়ে গেছেন ও মুষড়ে পড়েছেন’ বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর তাঁর মিত্র ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবারই সশস্ত্র সংগঠনটিকে ‘নির্মূল করার’ অঙ্গীকার করেছেন। তবে তাঁর এই একমাত্র বিকল্প সমাধানকে বাস্তবে রূপ দিয়ে গাজায় ‘পরিপূর্ণ বিজয়’ অর্জন করা এখনো অধরাই রয়ে গেছে।

গত বুধবার যা দেখা গেল, তা হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট অধিকতর বাস্তব কিছু অর্জনে সমঝোতায় আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। কেননা, নিজেদের কাছে সন্ত্রাসী বলে বিবেচিত সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করার দীর্ঘদিনের নীতি থেকে সরে আসছে তাঁর সরকার।

আরও পড়ুন

ওই দিন হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘(গাজা যুদ্ধ অবসানে) সমঝোতায় নিযুক্ত মার্কিন বিশেষ দূতের যে কারও সঙ্গে কথা বলার কর্তৃত্ব রয়েছে।’

গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়ে এ উপত্যকা যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। তাঁর এ বাগাড়ম্বরের বাইরে দৃশ্যত মার্কিন সরকার নিজেদের কাছে থাকা ৫৯ জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে হামাস কী চায়, সেটিই এখন শুনতে চায়। এসব জিম্মির মধ্যে যাঁরা বেঁচে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন মার্কিন নাগরিক আছেন বলে মনে করা হচ্ছে; আর মৃত জিম্মিদের মধ্যে রয়েছেন চারজন।

ট্রাম্পের গাজা দখলের বাগাড়ম্বরের বাইরে দৃশ্যত মার্কিন সরকার নিজেদের কাছে থাকা ৫৯ জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে হামাস কী চায়, সেটিই এখন শুনতে চায়। এই জিম্মিদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন মার্কিন নাগরিক আছেন বলে মনে করা হচ্ছে; আর মৃত জিম্মিদের মধ্যে রয়েছেন চারজন।

গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা ও জিম্মি মুক্তি নিয়ে আগে হামাসের সঙ্গে যত আলোচনা হয়েছে, তার সবই হয়েছে কাতার ও মিসরের সরাসরি মধ্যস্থতায়।

সশস্ত্র সংগঠন হামাসের প্রতিষ্ঠা ১৯৮০–এর দশকের শেষ দিকে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সংগ্রামে যুক্ত সংগঠনটি। দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনটি ইসরায়েলকে ধ্বংস করার পক্ষে প্রচার চালিয়ে এসেছে। তবে ২০১৭ সালে সংগঠনটি বলেছে, গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম নিয়ে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে মেনে নেবে তারা।

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবনের সামনে বসে আছেন এক ফিলিস্তিনি তরুণ
ফাইল ছবি: এএফপি
আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক আইনে গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমকে সামরিকভাবে ইসরায়েলে দখল করে নেওয়া এলাকা হিসেবে ধরা হয়।

গাজায় ইসরায়েলের চালানো ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য, হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরানো ও দেশটিকে হুমকি দেওয়ার সক্ষমতা নষ্ট করা।

এ দুই লক্ষ্যের অন্তত প্রথমটির ব্যাপারে বিদেশে অবস্থানরত হামাস নেতারা ক্রমেই আরও বেশি স্পষ্ট করে দিচ্ছেন যে সংগঠনটি গাজার শাসনক্ষমতা থেকে সরে যেতে রাজি আছে।

(গাজা যুদ্ধ অবসানে) সমঝোতায় নিযুক্ত মার্কিন বিশেষ দূতের যে কারও সঙ্গে কথা বলার কর্তৃত্ব রয়েছে।
-ক্যারোলিন লেভিট, হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি

গত মাসে হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম আল আরাবিয়া টেলিভিশনকে বলেছেন, ‘আমরা পরিষ্কার করে বলছি, পরবর্তী দফায় গাজায় রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক বন্দোবস্তের অংশ হওয়াটা হামাসের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু নয়।’

গাজা নিয়ে ট্রাম্পের ঘোষণা করা সাম্প্রতিক পরিকল্পনার জবাবে চলতি সপ্তাহে নিজেদের পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন আরব নেতারা। প্রস্তাবে গাজায় অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, যেখানে হামাস থাকবে না। পরিকল্পনায় দ্রুতই সম্মতি জানিয়েছে সশস্ত্র সংগঠনটি।

ইসরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালানোর সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা, স্বাস্থ্যসেবা ও মৌলিক মিউনিসিপ্যাল পরিষেবা দেওয়া সংগতিপূর্ণ নয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাস জিতে ২০০৭ সালের গ্রীষ্মে গাজার শাসনভার গ্রহণ করে। তখন থেকেই এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে, হামাস এ দুই বিষয় একসঙ্গে চালাতে পারবে না।
-মুখাইমার আবুসাদা, ফিলিস্তিনি অধ্যাপক

মুখাইমার আবুসাদা রাজনীতিবিষয়ক একজন ফিলিস্তিনি অধ্যাপক। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তিনি গাজা ছেড়ে চলে যান। সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘শাসনক্ষমতা এ সংগঠনের জন্য একটা বোঝা হয়ে উঠেছে।’

হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়া (বাঁয়ে) ও ইয়াহিয়া সিনওয়ার (মাঝে)। গাজা সিটি, মার্চ ২০১৭। গত বছর ইসরায়েল এ দুই নেতাকেই হত্যা করেছে
ছবি: রয়টার্স
আরও পড়ুন

এই অধ্যাপক বলেন, ইসরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালানোর সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা, স্বাস্থ্যসেবা ও মৌলিক মিউনিসিপ্যাল পরিষেবা দেওয়া সংগতিপূর্ণ নয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাস জিতে ২০০৭ সালের গ্রীষ্মে এ উপত্যকার শাসনভার গ্রহণ করে। তখন থেকেই এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে, হামাস এ দুই বিষয় একসঙ্গে চালাতে পারবে না।’

গাজা নিয়ে ট্রাম্পের ঘোষণা করা সাম্প্রতিক পরিকল্পনার জবাবে চলতি সপ্তাহে নিজেদের পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন আরব নেতারা। প্রস্তাবে গাজায় অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, যেখানে হামাস থাকবে না। পরিকল্পনায় দ্রুতই সম্মতি জানিয়েছে সশস্ত্র সংগঠনটি।

কিন্তু চলতি সংকটে যে বিষয়টি অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে, তা হলো, হামাস নিরস্ত্র হবে কি না। প্রবীণ ইসরায়েলি মধ্যস্থতাকারী থেকে শান্তিকর্মী হয়ে ওঠা গারশন বাস্কিন সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমি জানি, এ বিষয়ে বিদেশে হামাস নেতাদের মধ্যে কথাবার্তা চলছে এবং এ নিয়ে তাঁরা বিভক্ত।’

অতিসম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে হামাসের মুখপাত্র সামি আবু জুহরি বলেন, হামাস অস্ত্র সমর্পণ করবে—এ ধারণা ‘একটি রেডলাইন এবং এটি আলোচনা বা সমঝোতা করার জন্য উপযুক্ত নয়।’

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হামাসের সঙ্গে আলোচনা করছে, বিষয়টি উদ্‌ঘাটিত হওয়ার পর ট্রাম্প সংগঠনটির সঙ্গে কী সমঝোতা করতে পারেন, তা নিয়ে স্পষ্টতই স্নায়ুবিক চাপে ভুগছেন ইসরায়েলি নেতারা। নেতানিয়াহুর কার্যালয় এ নিয়ে এক চাঁছাছোলা বিবৃতি দিয়েছে। তাতে বলা হয়, ‘হামাসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আলোচনা করা নিয়ে ইসরায়েল তার অবস্থান জানিয়েছে।’ অবশ্য কী সেই অবস্থান, তা বলা হয়নি বিবৃতিতে।

এখন ট্রাম্প কত দূর যান, সেটিই দেখার বিষয়।

আরও পড়ুন