জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ছবি থেকে যে ৫ বিষয় জানা গেল

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে তোলা ছবি
নাসার সৌজন্যে

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তোলা পাঁচটি ছবি গত মঙ্গলবার উন্মুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা। এ ছবিগুলো গভীর মহাকাশের গোপন রহস্যের সমাধান করার জন্য টেলিস্কোপটির দুর্দান্ত সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা ছবিগুলো থেকে আমরা আর যা যা জানতে পেরেছি, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। জেনে নিন সেগুলো—

টেলিস্কোপটি খুব ভালোভাবে কাজ করে

হাবল টেলিস্কোপের তোলা ঝাপসা ছবি থেকে নাসার অভিজ্ঞতা ছিল যে অনেক সময় অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আশানুরূপ কাজ করে না। এ সমস্যা সমাধানে নভোচারীরা একাধিকবার মহাকাশে গেছেন এবং হাবলের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো মেরামতকাজ সম্ভব নয়।

কারণ, পৃথিবী থেকে এটি অনেক দূরে মহাকাশে অবস্থিত। এখন পর্যন্ত এত দূর কোনো নভোচারী যেতে পারেননি। উৎক্ষেপণের প্রত্যাশা ও উদ্বেগ পেরিয়ে টেলিস্কোপ স্থাপনের পর এর যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তা নিশ্চিত করতে কাজ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

আরও পড়ুন

গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এ টেলিস্কোপের অপারেশন প্রজেক্ট সায়েন্টিস্ট জেন রিগবি বলেন, তাঁদের প্রত্যাশা অনুযায়ী দারুণ কাজ করেছে টেলিস্কোপটি। এর পাঠানো দারুণ ঝকঝকে ছবি দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা যা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও ভালো কাজ করেছে টেলিস্কোপটি। এই টেলিস্কোপ ঘিরে অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা হচ্ছে। ইতিমধ্যে জেমস ওয়েবের ছবি নিয়ে ১৩টির বেশি বৈজ্ঞানিক কর্মসূচি শুরু হয়েছে, যা জেমস ওয়েব–যুগ সূচনার ইঙ্গিত দেয়। এসব গবেষণার মধ্যে রয়েছে—আমাদের সৌরজগৎ, ছায়াপথ, কৃষ্ণগহ্বর, নক্ষত্র সৃষ্টি ও বিবর্তনের মতো নানা বিষয়।’ রিগবি বলেন, ‘এসব বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের ফলাফলগুলো এখন থেকে পাওয়া সম্ভব হবে।’

মহাবিশ্বের অতীতের ঘটনাপ্রবাহ জানার সুযোগ

গত সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে তোলা একটি ছবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা এ ছবিকে মহাকাশের অনেক গভীর থেকে তোলা ছবি হিসেবে বর্ণনা করে। নাসার কম্পিউটার থেকে এ ছবি নিয়ে আরও গবেষণা করা হলে আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। ছবিটি মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর একটি অংশকে ধারণ করেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে এসএমএসিএস ০৭২৩। ছবিটি আকাশে ছড়িয়ে থাকা আরও দূরবর্তী ছায়াপথের উপস্থিতি প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ছবিতে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা জ্বলজ্বলে আলোক রশ্মির বিচ্ছুরণ ফুটে উঠেছে। মহাবিশ্বের প্রাচীনতম রূপ এটি। ১ হাজার ৩০০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের ছবি এটি।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের তত্ত্ব অনুযায়ী, সবচেয়ে দূরবর্তী আদি নক্ষত্রগুলোকে আজকে আমরা যেভাবে দেখছি, এর চেয়ে ভিন্নরূপ হতে পারে। আদি নক্ষত্রগুলো মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং থেকে অবশিষ্ট বিশুদ্ধ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে গঠিত ছিল। এগুলো পরে সূর্যের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে এবং দ্রুত পতন ঘটে বৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরে রূপ নিতে পারে। অধিকাংশ ছায়াপথের কেন্দ্রে এ ধরনের কৃষ্ণগহ্বরের দেখা মেলে।

আরও পড়ুন

দূরবর্তী গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডলের তথ্য জানাবে

গত মঙ্গলবার বৃহস্পতি গ্রহের মতো বড় একটি এক্সোপ্লানেটের তথ্য প্রকাশ করেছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। নাসার পক্ষ থেকে বুধবার বলা হয়েছে, ১ হাজার ১৫০ আলোকবর্ষ দূরে ডব্লিউএএসপি-৯৬বি নামের ওই গ্যাসীয় গ্রহটির অবস্থান। সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রকে ঘিরে আবর্তন করা উষ্ণ বায়ুমণ্ডলের পৃথিবীসদৃশ ওই গ্রহে (এক্সোপ্লানেট) মেঘ ও কুয়াশা থাকার প্রমাণও মিলেছে।

নাসার এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গ্রহ হিসেবে এখন পর্যন্ত ডব্লিউএএসপি-৯৬বিকে বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে এ টেলিস্কোপ দিয়ে। এ থেকে দূরবর্তী পৃথিবীসদৃশ গ্রহটির বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করার জন্য এ টেলিস্কোপের অভূতপূর্ব সক্ষমতা লক্ষ করা গেল। এক্সোপ্লানেটটিকে আগে ভূমি থেকে এবং হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে সেখানে যে পানির বাষ্প, কুয়াশা ও মেঘের প্রমাণ পেয়েছে, তা আগে সম্ভব হয়নি।

এটি বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছে। যদিও ডব্লিউএএসপি-৯৬বিতে বসবাসের উপযোগী কোনো পরিবেশ নেই, তবু এ ধরনের কৌশল প্রয়োগে আরও ছোট পাথুরে বসবাসযোগ্য পৃথিবীসদৃশ গ্রহের সন্ধান করা যেতে পারে। অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোর্তিবিদ মেগান ম্যানসফিল্ড বলেন, ‘আমাদের আগ্রহ তৈরি করতে পারে এমন গ্রহ হয়তো আমরা খুঁজে পাব। সেখানে সম্ভবত জীবনের সন্ধানও মিলতে পারে।’ কিন্তু এখন পর্যন্ত পৃথিবীসদৃশ ছোট আকারের গ্রহ পর্যবেক্ষণ করা কঠিন। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এ সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবে।

আরও পড়ুন

অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার সম্ভব হবে

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ স্টিফানস কুইন্টেট নামক ছায়াপথ গুচ্ছের ছবি সামনে এনেছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এ ছাড়া গ্যাস ও ধূলিকণায়ভরা মৃত নক্ষত্রের একটি সমাধিক্ষেত্রও দেখাতে সক্ষম হয়েছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছবি হবে কারিনা নেবুলা।

ধূলিকণার একটি বিস্তীর্ণ ঘূর্ণমান মেঘ, যা নক্ষত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। আমাদের আকাশগঙ্গার সবচেয়ে আলোকিত এবং বিস্ফোরক নক্ষত্রের বাড়ি এটি। ইনফ্রারেডে দেখা গেছে, নীহারিকাটিতে শত শত নক্ষত্রের বিন্দু বিন্দু আলো, যা আগে কখনো জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখেননি।

ছবিটিতে এমন কাঠামোও রয়েছে, যা বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করতে পারেননি। জ্যোর্তিবিদ আমায়া মোরো-মার্টিন বলেন, ‘অপ্রত্যাশিত অনেক কিছু খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই।’ জেমস ওয়েব থেকে এ ধরনের আরও আবিষ্কার সামনে আসবে।

টেলিস্কোপটি অত্যন্ত নাজুক

জেমস ওয়েবের মতো টেলিস্কোপ অত্যন্ত নাজুক। মহাকাশের যে কোনো ধূলিকণা বা গ্রহাণুর সঙ্গে এর আয়নার সংঘর্ষ ঘটতে পারে। গত মে মাসে অতি ক্ষুদ্র গ্রহাণুর সঙ্গে টেলিস্কোপটির আয়নার এমন সংঘর্ষ হয়েছে।

এ ধাক্কা বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক ছিল। এ ছাড়া আরও চারটি ক্ষুদ্র গ্রহাণুর সঙ্গে টেলিস্কোপটির সংঘর্ষ হয়েছে। এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তাও রয়েছে।