শিক্ষার্থী বিক্ষোভে বাম–ডান দুই দিক দিয়েই বিপদে বাইডেন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনফাইল ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের সমর্থনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো। গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রতিবাদে তাঁদের এই বিক্ষোভ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। ঘটছে নির্বিচার আটকের ঘটনাও।

অন্যদিকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে কূটনীতিকেরা জড়ো হয়েছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য, যুদ্ধবিরতি।

দেশে–বিদেশে এমন পরিস্থিতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে নতুন এক অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। বাম ও ডান—দুই মেরু থেকেই চাপে পড়েছেন বাইডেন।

সাম্প্রতিক আলোচনায় ইসরায়েলিরা উল্লেখযোগ্য ছাড় দিয়েছিল। হামাস বলেছিল যে চুক্তিতে পৌঁছাতে শর্তে রাজি হওয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
—ম্যাট মিলার, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র

বামপন্থীরা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি চান, শান্তি চান। আবার মার্কিনরা মনে করছেন, ক্যাম্পাসগুলোয় নজিরবিহীন এমন বিক্ষোভ শিক্ষার পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করছে। শান্তিশৃঙ্খলা নষ্টের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

ফিলিস্তিনের দক্ষিণাঞ্চলের রাফায় উদ্বাস্তুদের তাঁবুর সামনে টানানো একটি ব্যানার মনোযোগ কেড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে চলমান ছাত্রবিক্ষোভের বিষয়টি উঠে এসেছে তাতে। লেখা রয়েছে, ‘কলাম্বিয়ার শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ’।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভের সময় ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে (ইউসিএলএ) এক বিক্ষোভকারীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ২ মে, ২০২৪
ছবি: রয়টার্স

অনেক তাঁবুর সামনে যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভকারীদের কৃতজ্ঞতা ও সংহতি জানিয়ে ব্যানার টানানো হয়েছে। কয়েকজন আমেরিকান সাংবাদিক এসব ছবি–ভিডিও করে প্রকাশ করেছেন। এতে বোঝা যায়, চলমান বিক্ষোভের রেশ মার্কিন ভূখণ্ড ছাড়িয়ে রাফাতেও পৌঁছে গেছে।

গত কয়েক সপ্তায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ২ হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে পুলিশ।

গত মঙ্গলবার রাতে লস অ্যাঞ্জেলেসে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় ইসরায়েলপন্থীদের মুখোশধারী একটি গোষ্ঠী বিক্ষোভকারীদের তাঁবুগুলোর ওপর হামলা চালায়। বাতিল হয়ে যায় ক্লাস। ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকা হয়। পুলিশ এসে বিক্ষোভকারীদের তাঁবু উঠিয়ে দেয়।

অনেকটা একই চিত্র দেখা গেছে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিক্ষোভকারীরা একটি প্রশাসনিক ভবন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। পরে পুলিশ গিয়ে বিক্ষোভকারীদের ও তাঁদের তাঁবুগুলো সরিয়ে দেয়। আটক হন অনেকেই

এমন এক সময়ে এই অশান্ত পরিবেশ দেখা দিয়েছে যখন গাজায় যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী রাফায় বড় পরিসরে স্থল অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। গাজার ১০ লাখের বেশি উদ্বাস্তু এখন রাফায় আশ্রয় নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সেখানে অভিযানের আগে ইসরায়েল বলছে, হামাসের সর্বশেষ দুর্গ রাফা। তাই সেখানে অভিযান চালানো হবে।

ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে এক বিক্ষোভকারী। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে
ফাইল ছবি: এএফপি

হামাস ও ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি করাতে কয়েক সপ্তাহ ধরে চাপ দিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। এ চুক্তিতে একদিকে যেমন হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের কয়েকজনের মুক্তির সুযোগ রাখা হবে। অন্যদিকে অবরুদ্ধ গাজায় উপত্যকায় আরও সহায়তা প্রবেশের সুযোগ থাকবে। ফিলিস্তিনিদের গাজার উত্তরাংশে ফেরার সুযোগের বিষয়টিও চুক্তিতে থাকতে পারে।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। গত অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি অভিযান শুরুর পর এটা তাঁর সপ্তম মধ্যপ্রাচ্য সফর। এবারের সফরে আরব ও ইসরায়েলি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি রাফায় অভিযান ঠেকাতে শেষ চেষ্টা করেছেন। কেননা বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাফায় অভিযান মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গত বৃহস্পতিবারের ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাট মিলার বলেন, সাম্প্রতিক আলোচনায় ইসরায়েলিরা উল্লেখযোগ্য ছাড় দিয়েছিল। হামাস বলেছিল যে চুক্তিতে পৌঁছাতে শর্তে রাজি হওয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

মিশিগান ও উইসকনসিনের মতো অঙ্গরাজ্যগুলোয় জনপ্রিয়তার ব্যবধান খুবই সামান্য। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এসব অঙ্গরাজ্যের ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। আমার মতে, গাজা যুদ্ধের জন্য এটা আরও গুরুত্ববহ হয়ে উঠতে পারে।
—জেসিকা উইকস, উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক
আরও পড়ুন

গত শুক্রবার হামাসের নেতৃত্ব জানায়, সাম্প্রতিক প্রস্তাবের বিষয়ে ‘ইতিবাচক মনোভাব’ নিয়ে পর্যালোচনা করছে তারা। শনিবার (৪ মে) থেকে মিসরের কায়রোয় শান্তি আলোচনা শুরু হচ্ছে। সেখানেও প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে হামাস।

শান্তি আলোচনায় যেকোনো অগ্রগতি বাইডেন প্রশাসনের জন্য সুখবর বয়ে আনবে। স্বাগত জানাবে ওয়াশিংটন। কেননা, গাজা উপত্যকায় বেসামরিক মানুষের রক্তপাত ও দুর্ভোগ কিছু সময়ের জন্য দূর হলেও বাইডেন প্রশাসনের ওপর জেঁকে বসা চাপ কমে আসবে।

সংবাদ সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে মার্কিন তৎপরতার পেছনে চলমান ছাত্রবিক্ষোভের প্রভাব থাকার কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন মিলার। তবে তিনি বলেছেন, দেশে–বিদেশে অশান্তি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের প্রচার এড়ানো কঠিন ছিল। ব্লিঙ্কেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় বিভিন্ন আলোচনায়ও এ বিষয়টি উঠে এসেছে।

চলমান ছাত্রবিক্ষোভে বাইডেনের ওপর চাপ বেড়েছে—এ কথা স্বীকার করতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তারা।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী রাফায় বড় পরিসরে স্থল অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। গাজার ১০ লাখের বেশি উদ্বাস্তু এখন রাফায় আশ্রয় নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সেখানে অভিযানের আগে ইসরায়েল বলছে, হামাসের সর্বশেষ দুর্গ রাফা। তাই সেখানে অভিযান চালানো হবে।
আরও পড়ুন

ইসরায়েলের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন থেকে সরে আসার জন্য কয়েক মাস ধরে বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন বাম ঘরানার ডেমোক্র্যাটেরা। কিন্তু রাজনৈতিক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাইডেন এমন নীতিতে অটল। মার্কিন তরুণ ও কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের অনেকের মধ্যেই গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে সমালোচনামূলক মনোভাব তৈরি হচ্ছে। আর এই ভোটারদের বড় অংশই ডেমোক্র্যাটপন্থী।

আসছে নভেম্বরের নির্বাচনে বাইডেন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলো অন্তত তাই বলছে। নির্বাচনে ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোর (ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটস) ভোটাররা। এসব অঙ্গরাজ্যে বাইডেনের প্রতি সমর্থন কিছুটা কমে এসেছে।

ইসরায়েলের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন থেকে সরে আসার জন্য কয়েক মাস ধরে বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন বাম ঘরানার ডেমোক্র্যাটরা। কিন্তু রাজনৈতিক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাইডেন এমন নীতিতে অটল। মার্কিন তরুণ ও কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের অনেকের মধ্যেই গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে সমালোচনামূলক মনোভাব তৈরি হচ্ছে।

এ বিষয়ে উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জেসিকা উইকস বলেন, মিশিগান ও উইসকনসিনের মতো অঙ্গরাজ্যগুলোয় জনপ্রিয়তার ব্যবধান খুবই সামান্য। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এসব অঙ্গরাজ্যের ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। আমার মতে, গাজা যুদ্ধের জন্য এটা আরও গুরুত্ববহ হয়ে উঠতে পারে।

অন্তত এখন পর্যন্ত এটাকে এমন একটি ঝুঁকি বলেই মনে হচ্ছে, যা বাইডেন গ্রহণ করে নিতে ইচ্ছুক।

সর্বোপরি, গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হোয়াইট হাউসে বাইডেনকে স্বস্তির নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ এনে দেবে ঠিকই। কিন্তু বাইডেনের সামনে থেকে শক্তিশালী রাজনৈতিক হুমকি দূর করার জন্য গাজায় যে ধরনের টেকসই শান্তি প্রয়োজন, তা এখনো অধরাই রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন