ঐতিহাসিকভাবেই ইরান-সৌদি আরব সম্পর্কে বৈরিতা রয়েছে। এরই মধ্যে সৌদি আরবে একজন খ্যাতনামা শিয়া ধর্মীয় নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এর জেরে ২০১৬ সালে রিয়াদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ইরান।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার মূল্য সৌদি সরকারকে দিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত অক্টোবরে আবার শীর্ষ জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাস তেলের উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দেয়। সৌদি আরব এই জোটের সদস্য।
পশ্চিমাদের আপত্তির মুখে এই ঘোষণা নিয়ে বাইডেন বলেছিলেন, রিয়াদের এই পদক্ষেপ রাশিয়ার জন্য সুবিধা করে দিয়েছে। তাই সৌদি সরকারকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১২১টি উড়োজাহাজ কেনার ঘোষণা দেয় সৌদি আরব। এরপর দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়ে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের অন্যান্য স্থানে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক স্বার্থ বজায় রাখতে চায় ওয়াশিংটন। এ লক্ষ্যে নানাভাবে সৌদি–যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখা যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।
চীনের কূটনৈতিক উদ্যোগগুলো একটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়। সেটি হলো অর্থ। তারা আফ্রিকা ও এশিয়ায় মিত্র বানিয়েছে। এসব মৈত্রীর বেশির ভাগের মূলে রয়েছে অর্থসংক্রান্ত বিষয়। এই ধরনের সম্পর্ক স্থায়ী মৈত্রী তৈরি করে নামাইলস ইউ, হাডসন ইনস্টিটিউটের চায়না সেন্টারের পরিচালক
মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে চীন যখন নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করছে, তখন উড়োজাহাজ কেনার এই ঘোষণায় মনে হচ্ছে, সৌদি আরবও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যায়। হোয়াইট হাউসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আবার চালু করতে দুই বছর আগে থেকে আলোচনা চালিয়ে আসছে সৌদি আরব। এ আলোচনা নিয়ে সৌদি কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনকে সব সময় হালনাগাদ তথ্য দিয়ে এসেছেন। চীন ছাড়াও তেহরান–রিয়াদ আলোচনায় এর আগে মধ্যস্থতা করেছে ইরাক ও ওমান। তবে যুক্তরাষ্ট্র কখনো তাতে অংশ নেয়নি।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে চীনের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহও রয়েছে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের। এর মধ্যে একটি সমস্যা হলো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ইয়েমেন যুদ্ধ। ২০১৪ সালে ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে নেয় ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা।
ঐতিহাসিকভাবেই ইরান–সৌদি সম্পর্কে বৈরিতা রয়েছে। এরই মধ্যে সৌদি আরবে একজন খ্যাতনামা শিয়া ধর্মীয় নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এর জেরে ২০১৬ সালে রিয়াদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ইরান। তেহরানে অবস্থিত সৌদি দূতাবাস ভাঙচুর করেন বিক্ষোভকারীরা। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, এই মৃত্যুদণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এর সাত বছর পরে এসে দুই দেশের সম্পর্ক জোড়া লাগতে যাচ্ছে।
আর এতে চীনের বড় ভূমিকা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রও নাকি এটাই চাইত। চলতি সপ্তাহে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেছেন, উপসাগরীয় দেশগুলো ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবানন ও ইরাকে ‘প্রক্সি যুদ্ধে’ জড়িয়ে গেছে। এই অঞ্চলে উত্তেজনা কমাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। চীন সে পথেই এগিয়েছে। এটাকে যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।
তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে চীনের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহও রয়েছে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের। এর মধ্যে একটি সমস্যা হলো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ইয়েমেন যুদ্ধ। ২০১৪ সালে ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে নেয় ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা। এর জেরে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেন সরকারের কর্মকর্তারা সৌদি আরবে আশ্রয় নেন। পরের বছর এই সরকারের পক্ষে হুতিদের বিরুদ্ধে ইয়েমেনে যুদ্ধে নামে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী।
ভয়াবহ এই যুদ্ধে সবচেয়ে দীর্ঘ ছয় মাসব্যাপী যুদ্ধবিরতি গত অক্টোবরে শেষ হয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে ইয়েমেনে স্থায়ীভাবে শান্তি আনার বিষয়ে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, চলতি সপ্তাহে সৌদি আরব ও ওমান সফর করবেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত টিম লেনডারকিং। তাঁর লক্ষ্য, জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সাম্প্রতিক ওই যুদ্ধবিরতি আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা এপিকে বলেছেন, বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় এমন এক সময় ইরান–সৌদি সমঝোতায় গেল, যখন ‘গাছের ফল পাকতে শুরু করেছে’। তাঁর ভাষ্যমতে, চীন যদি ইয়েমেনের সংঘাত বন্ধে ‘বাড়তি কোনো ভূমিকা’ রাখতে পারে, তা যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখেই দেখবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব—দুই দেশের কর্মকর্তারা ইয়েমেন যুদ্ধ থামাতে ইরানের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দিহান।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য চীন। ইয়েমেন যুদ্ধ, সিরিয়া যুদ্ধ বা ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে এখন পর্যন্ত খুব কম আগ্রহ দেখিয়েছে দেশটি। তবে ইরান–সৌদি সমঝোতার পর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং জানিয়েছেন, বৈশ্বিক বিভিন্ন বিষয়ে আরও বড় পরিসরে ভূমিকা পালন করবে তাঁর দেশ। আর বুধবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জাতিসংঘে চীনের উপদূত গেং শুয়াং বলেছেন, ইয়েমেন পরিস্থিতির উন্নতির বিষয়ে তাঁরাও আশাবাদী।
এদিকে সৌদি আরব ও ইরানের জ্বালানি তেলের বড় ক্রেতা চীন। গত ডিসেম্বরে সি চিন পিং সৌদি আরব সফরে গিয়েছিলেন। গত মাসে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বেইজিং এসেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে চীন আঞ্চলিক প্রভাব বাড়াতে চাচ্ছে। তবে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাডসন ইনস্টিটিউটের চায়না সেন্টারের পরিচালক মাইলস ইউয়ের মতে, চীন যদি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও সক্রিয় হতে চায়, তাহলে বেইজিংয়ের আচরণে বদল আনতে হবে।
মাইলস ইউ বলেন, ‘চীনের কূটনৈতিক উদ্যোগগুলো একটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়। সেটি হলো অর্থ। তারা আফ্রিকা ও এশিয়ায় মিত্র বানিয়েছে। এসব মৈত্রীর বেশির ভাগের মূলে রয়েছে অর্থসংক্রান্ত বিষয়। এই ধরনের সম্পর্ক স্থায়ী মিত্র তৈরি করে না।’
তবে বর্তমান সময়ে এসে চীন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও মধ্যপ্রাচ্যে আরও গভীরভাবে সম্পৃক্ত হতে বেইজিংয়ের সব পদক্ষেপই যে মার্কিনদের জন্য ক্ষতিকর হবে, তা মনে করেন না কানেটিকাটের ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস মারফি। তিনি বলেন, নিজেদের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে চীন মধ্যপ্রাচ্যে তৎপরতা বাড়াচ্ছে। সম্ভবত দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তাদের কাছে এটা বেশি জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন কারণে চীনের দিকে সৌদি আরবের ঝুঁকে পড়ায় অতটাও উদ্বিগ্ন নয় হোয়াইট হাউস। আর যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্রের বড় ক্রেতা সৌদি আরব। এটি নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছে না ওয়াশিংটন। কারণ, মার্কিন সমরাস্ত্র থেকে সরে রুশ কিংবা চীনা সমরাস্ত্রের দিকে যেতে অন্তত এক দশক সময় লাগবে রিয়াদের।
এ বিষয়ে রিয়াদভিত্তিক প্রতিরক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেথিয়ন অ্যারাবিয়ান সিস্টেমস কোম্পানির সাবেক প্রেসিডেন্ট লেজ জাঙ্কা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ—সবকিছুর সুবিধা সৌদি আরব পাচ্ছে, সেখান থেকে সরে দাঁড়াতে দেশটির ‘অবিশ্বাস্য পরিমাণ কর্মকাণ্ডের’ মধ্য দিয়ে যেতে হবে।