যুদ্ধ ও আঞ্চলিক উত্তেজনায় অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের আয়ের রেকর্ড, তালিকায় মাস্কের স্পেসএক্সও
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০০ অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গত বছর অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে রেকর্ড ৬৭৯ বিলিয়ন বা ৬৭ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছে।
সুইডেনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) নতুন এক প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান উঠে এসেছে।
গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধ, সেই সঙ্গে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং ক্রমে বাড়তে থাকা সামরিক ব্যয়ের ফলে দেশের ভেতর ও বাইরে ক্রেতাদের কাছে সামরিক পণ্য ও সামরিক সেবা বিক্রি অনেক বেড়ে গেছে। ফলে অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে গেছে।
সোমবার প্রকাশিত এসআইপিআরআইয়ের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিগুলোর কারণে বিশ্বব্যাপী অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চল ছাড়া বাকি সব অঞ্চলেই ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে অস্ত্র বিক্রি থেকে আয় বেড়েছে।
এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলে আয় কমার কারণ চীনের অস্ত্রশিল্প। দেশটিতে অস্ত্রশিল্পে নানা সংকটের কারণে পুরো অঞ্চলে অস্ত্রশিল্পের আয় হ্রাস পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সমরাস্ত্র বিক্রিতে শীর্ষে থাকা তিন প্রতিষ্ঠান হলো, লকহিড মার্টিন, নর্থরপ গ্রুম্যান ও জেনারেল ডাইনামিকস। গত বছর অস্ত্র বিক্রিতে শীর্ষ থাকা ১০০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯টি অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান জায়গা করে নিয়েছে।
২০২৪ সালে এসব প্রতিষ্ঠানের অস্ত্র বিক্রি থেকে আয় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৩৪ বিলিয়ন বা ৩৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার হয়েছে। র্যাংকিংয়ে জায়গা করে নেওয়া ৩৯ মার্কিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩০টিরই আয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স প্রথমবারের মতো সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০০ কোম্পানির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে অস্ত্র বিক্রি থেকে কোম্পানিটির আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ১৮০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স প্রথমবারের মতো সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০০ কোম্পানির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে অস্ত্র বিক্রি থেকে প্রতিষ্ঠানটির আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ১৮০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
ইউরোপের ২৬টি অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি প্রতিষ্ঠানের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি থেকে আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সেগুলোর মোট আয় ১৩ শতাংশ বেড়ে ১৫ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
২০২৪ সালে অস্ত্র বিক্রি করে সবচেয়ে বেশি আয় বেড়েছে চেক প্রজাতন্ত্রের অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান চেকস্লোভাক গ্রুপের। ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর তাদের আয় ১৯৩ শতাংশ বেড়ে ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছে গেছে। তালিকায় থাকা এ প্রতিষ্ঠানটি ইউক্রেনের কাছে আর্টিলারি শেল বিক্রি করে গত বছর সবচেয়ে বেশি আয় করেছে।
ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের কারণে দেশটির অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আয়ও বেড়েছে। এসআইপিআরআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনের জেএসসি ইউক্রেনিয়ান ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রির আয় ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
এসআইপিআরআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে ইউরোপের অস্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে কাঁচামালের চাহিদা বেড়েছে।
এসআইপিআরআই এ নিয়ে সতর্ক করে বলেছে, কাঁচামালের উৎস, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ খনিজের ওপর নির্ভরতার ক্ষেত্রে চীন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়ায় চ্যালেঞ্জ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
তালিকায় রাশিয়ার মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান স্থান পেয়েছে। সেগুলো হলো, রোস্টেক এবং ইউনাইটেড শিপবিল্ডিং করপোরেশন। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সত্ত্বেও তাদের সম্মিলিত আয় ২৩ শতাংশ বেড়ে ৩ হাজার ১২০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
আর গত বছর এশিয়া ও ওশেনিয়ার অস্ত্র নির্মাতাদের আয় ২০২৩ সালের তুলনায় ১ দশমিক ২ শতাংশ কমলেও তারা সম্মিলিতভাবে ১৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছে।
‘চীনা অস্ত্র ক্রয়ে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগের কারণে ২০২৪ সালে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র চুক্তি স্থগিত বা বাতিল করা হয়েছে।’
এই অঞ্চলের আয় কমে যাওয়ার কারণ হলো, র্যাঙ্কিংয়ে থাকা ৮টি চীনা অস্ত্র কোম্পানির আয় সম্মিলিতভাবে ১০ শতাংশ হ্রাস পাওয়া।
এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো চীনের অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এনওআরআইএনসিওর আয় ৩১ শতাংশ হ্রাস পাওয়া।
এসআইপিআরআইয়ের মিলিটারি এক্সপেন্ডিচার অ্যান্ড আর্মস প্রোডাকশন প্রোগ্রামের পরিচালক ন্যান টিয়ান বলেন, ‘চীনের অস্ত্র ক্রয়ে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগের কারণে ২০২৪ সালে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র চুক্তি স্থগিত বা বাতিল করা হয়েছে। এতে চীনের সামরিক আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা এবং নতুন সক্ষমতা কখন কার্যকর হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়ছে।’
চীনের অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কমলেও জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার অস্ত্র নির্মাতাদের বিক্রি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণ হিসেবে ইউরোপ থেকে অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাইওয়ান ও উত্তর কোরিয়া ঘিরে আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধিও স্থানীয়ভাবে অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
র্যাঙ্কিংয়ে থাকা পাঁচ জাপানি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত আয় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৩৩০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। তালিকায় জায়গা পাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার চারটি প্রতিষ্ঠানের আয় ৩১ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৪১০ কোটি মার্কিন ডলারে উঠেছে।
গাজা যুদ্ধে ফুলেফেঁপে উঠছে ইসরায়েলের অস্ত্র ব্যবসা
এসআইপিআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ৯টি অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানি আয়ের দিক থেকে শীর্ষ ১০০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এই ৯টি কোম্পানি ২০২৪ সালে মোট ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার আয় করেছে, যা এই অঞ্চলে ১৪ শতাংশ আয় বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে সুদানের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ করা হয়েছে।
এসআইপিআরআই বলেছে, ২০২৩ সালে অস্ত্র বিক্রি থেকে আয়ের পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় তাদের তালিকায় আমিরাতভিত্তিক অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানি ইডিজিইকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আমিরাত সুদানে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
২০২৪ সালে অস্ত্র বিক্রি করে সবচেয়ে বেশি আয় বেড়েছে চেক প্রজাতন্ত্রের অস্ত্র কোম্পানি চেকস্লোভাক গ্রুপের। ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর তাদের আয় ১৯৩ শতাংশ বেড়ে ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছে গেছে। তালিকায় থাকা এই কোম্পানিটি ইউক্রেনের কাছে আর্টিলারি শেল বিক্রি করে গত বছর সবচেয়ে বেশি আয় করেছে।
র্যাঙ্কিংয়ে থাকা তিনটি ইসরায়েলি অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান গাজা যুদ্ধের মধ্যে তাদের সম্মিলিত আয় ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১ হাজার ৬২০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। গাজা যুদ্ধে প্রায় ৭০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলভিত্তিক আন্তর্জাতিক সামরিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেমস ২০২৪ সালে ৬২৮ কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছে। এর পরে আছে ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ, আয় ৫১৯ কোটি মার্কিন ডলার। তারপর রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস, আয় ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার।
এসআইপিআরআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের মনুষ্যবিহীন উড়োজাহাজ ও কাউন্টার-ড্রোন সিস্টেমে আন্তর্জাতিক আগ্রহ বেড়েছে।
রাফায়েলের আয়ের উত্থান ইরানের সঙ্গে সম্পর্কিত। ২০২৪ সালের এপ্রিল ও অক্টোবরে ইসরায়েলে ইরানের বড় ধরনের প্রতিশোধমূলক হামলার পর রাফায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার চাহিদা অপ্রত্যাশিত মাত্রায় বেড়ে গেছে। ইরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালিয়েছিল।
শীর্ষ ১০০ তালিকায় তুরস্কের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান জায়গা পেয়েছে। দেশটির জন্য এটি নতুন এক রেকর্ড। তুরস্কের পাঁচটি অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত আয় ২০২৩ সালের তুলনায় ১১ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ১০ কোটি ডলার হয়েছে।
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ভারত, তাইওয়ান, নরওয়ে, কানাডা, স্পেন, পোল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়ার সামরিক অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানও র্যাঙ্কিংয়ে জায়গা পেয়েছে।