ইরানের সঙ্গে ট্রাম্পের চুক্তিভঙ্গের ঘোষণায় অস্বস্তিতে যুক্তরাজ্য

যুক্তরাষ্ট্র যেদিকে যুক্তরাজ্য সেদিকে—আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দেশ দুটির এমন ঘনিষ্ঠতা দেখেই অভ্যস্ত বিশ্ব। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে বহুজাতিক পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেওয়ায় চরম অস্বস্তিতে পড়েছে বন্ধুদেশ যুক্তরাজ্য।

ট্রাম্পকে চুক্তিতে রাখতে না পারার বিষয়টি যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের মিত্রদেশগুলোর চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে, এই চুক্তির পক্ষে অবস্থান বজায় রাখতে গেলে জাতশত্রু রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে হবে যুক্তরাজ্যকে। আবার যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই চুক্তি কার্যকর রাখতে গেলে ওয়াদা মোতাবেক ইরানের সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের কোম্পানিগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত অবরোধ উপেক্ষা করে সে কাজ কতটা সম্ভব? এই চুক্তি বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ইউরোপীয় মিত্ররা কতটাই-বা কঠোর হতে পারবে, সেটাও বড় প্রশ্ন।

ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ঠেকাতে পশ্চিমা বিশ্ব বহু বছর ধরে দেশটির ওপর বাণিজ্য অবরোধ দিয়ে রাখে। তাতে কাজ না হওয়ায় ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। কথা ছিল, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে সরে আসবে। বিনিময়ে দেশটির ওপর থেকে অবরোধ উঠিয়ে নেওয়া হবে। সেই থেকে ওই চুক্তি মোতাবেক হচ্ছিল সবকিছু।

জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামের ওই সমঝোতা ‘ইরান ডিল’ নামেও পরিচিত। ছয়টি দেশ ইরানের সঙ্গে ওই চুক্তি করে। দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও চীন।

রাশিয়া ও চীন বরাবরই ইরানের প্রতি নমনীয়। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি এই চুক্তি বজায় রাখার পক্ষে। ট্রাম্প চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেওয়ার পর যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি এক যৌথ বিবৃতিতে ‘দুঃখ ও উদ্বেগ’ প্রকাশ করে বলেছে, তারা চুক্তিটি কার্যকর রাখতে কাজ করে যাবে। এই তিন মিত্রদেশ চুক্তি কার্যকর রাখতে বাধা হয়, এমন কোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগ থেকেই বলে আসছেন যে বারাক ওবামার প্রশাসন ইরানের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে, তা ‘জঘন্য, ধ্বংসাত্মক ও বোকামি’। নির্বাচিত হলে তিনি ওই চুক্তি বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দেন। ইরানের সামরিক শক্তি আরও সীমিত করার বাধ্যবাধকতা যুক্ত করে নতুন চুক্তি করতে চান ট্রাম্প।

সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার ইরান চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই সঙ্গে তিনি ইরানের ওপর সর্বোচ্চ অবরোধ আরোপের ঘোষণা দেন। একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে তিনি ইরানের সঙ্গে সব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য নিষিদ্ধ করেন। ট্রাম্প বলেন, অবরোধ অমান্য করলে কোম্পানিগুলো কঠিন সাজার মুখোমুখি হবে। কোম্পানিগুলোকে ইরানের সঙ্গে বিদ্যমান লেনদেন চুকিয়ে নিতে ছয় মাস পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।

সমঝোতা অনুযায়ী প্রতি ছয় মাস পরপর চুক্তিটি নবায়ন হয়। গত শনিবার আবারও সেটি নবায়নের কথা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প চুক্তি নবায়নে সম্মতি দেবেন না—এমন কথা কয়েক সপ্তাহ আগ থেকেই শোনা যাচ্ছিল।

সম্প্রতি জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁ যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই চুক্তি থেকে সরে না আসার অনুরোধ জানান। সর্বশেষ শনিবার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। তিনি ট্রাম্পের সাক্ষাৎ পাননি। তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইরান চুক্তি বজায় রাখার অনুরোধ করেন।

বরিস জনসন নিউইয়র্ক টাইমসে মতামত লিখে এবং ফক্স নিউজের একটি অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। তিনি ট্রাম্পের উদ্দেশে বলেন, ইরান চুক্তিতে ত্রুটি আছে। সেগুলো ঠিক করার জন্য একসঙ্গে কাজ করা যেতে পারে।

কিন্তু দীর্ঘদিনের মিত্র এসব দেশের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এটিকে ইউরোপের মিত্রদের কূটনৈতিক পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের জন্য এ পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর। কারণ, কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্যের সলসব্যারিতে আশ্রিত এক রুশ চরকে রাসায়নিক বিষ প্রয়োগের ঘটনায় দেশটির সঙ্গে রাশিয়ার টানাপোড়েন তৈরি হয়। ওই ঘটনায় যুক্তরাজ্যের পক্ষ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ৬০ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। এখন ইরান চুক্তি প্রশ্নে যুক্তরাজ্যের অবস্থান অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিরশত্রু রাশিয়ার দিকেই ঝুঁকে গেল।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছেদ (ব্রেক্সিট নামে পরিচিত) কার্যকর করা নিয়েও চরম বেকায়দায় রয়েছে যুক্তরাজ্য। ফলে, ইউরোপের অন্যতম শক্তি ফ্রান্স ও জার্মানির মন রক্ষাও আপাতত খুব জরুরি।

সব মিলিয়ে ইরান চুক্তি প্রশ্নে যুক্তরাজ্যের অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে এক বিরল চিত্র দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একদিকে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান, অন্যদিকে ব্রেক্সিট নিয়ে দর-কষাকষির প্রতিপক্ষ জার্মান ও ফ্রান্সের সঙ্গে জোট। যেখানে সঙ্গে আছে চক্ষুশূল রাশিয়াও।