নারী নির্যাতন

অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা—এই ধারণার ভিত্তি নেই

বাংলাদেশে ফৌজদারি অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা, মিথ্যা সাক্ষী ইত্যাদি অহরহই হয় এবং এ ধরনের মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে শাস্তির বিধানও রয়েছে। কিন্তু তারপরও শুধু নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রেই এই মিথ্যা মামলার বিষয়টি এমনভাবে প্রচারিত হয় যেন নারী নির্যাতনের মামলা মানেই মিথ্যা মামলা। অথচ বাস্তবে বরং নির্যাতনের শিকার নারীর ভাগ্যে বেশির ভাগ সময়ই ন্যায়বিচার জোটে না বহুবিধ আইনি জটিলতা আর আইন প্রয়োগের দুর্বলতার কারণে। নারী নির্যাতনের এই মিথ্যা মামলার অপবাদের বিষয়টি নিয়ে লেখার প্রয়োজন মনে হলো, কেননা নারীর আইনি অধিকার-সংক্রান্ত যেকোনো সংলাপ আর আলোচনায় এই প্রশ্নই ঘুরেফিরে আসে বছর বছর।

এ প্রশ্নের একটি সহজ উত্তর হলো যাঁরা বলেন ‘অধিকাংশ’ নারী নির্যাতনের মামলা মিথ্যা, তাঁরা কোন জরিপ বা গবেষণার ভিত্তিতে এমন তথ্য পেলেন, তা কিন্তু বলতে পারেন না। আর বলতে পারার কথাও নয়। কেননা এমন কোনো জরিপ করাই হয়নি এ পর্যন্ত, আর জরিপ করা আদৌ সম্ভব কি না, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। নির্ভর করে আমরা মিথ্যা মামলা বলতে কী বোঝাচ্ছি তার ওপর। একটি মামলা মিথ্যা হবে আইনত তখনই, যখন তা উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে করা হবে। যদি মামলার মাঝপথে বাদী-বিবাদীর মধ্যে গোপনে আপস হয়ে যাওয়ার কারণে আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির না করা হয়, আর এ কারণে আসামিকে যদি খালাস দিয়ে দেওয়া হয়, অথবা বাদী যদি শেষমেশ তাঁর সাক্ষ্যপ্রমাণাদি দিয়ে অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন, তবে সেই মামলাগুলোকে কিন্তু মিথ্যা মামলার অপরাধের মধ্যে ফেলা যাবে না।

কিন্তু যখন ঢালাওভাবে নারী নির্যাতনের মামলাকে মিথ্যা বলা হচ্ছে, তখন কিন্তু এ ধরনের মামলাগুলোকেও মিথ্যা মামলার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। তাই কোনটি মিথ্যা মামলা আর কোনটি সত্যি, সেটি কাগজে-কলমে বের করা কঠিন। যে উপায়টি মোটামুটি পাকাপোক্তভাবে বলে দিতে পারে যে কয়টা মিথ্যা মামলা হয়েছে বা কয়জন ভুক্তভোগী মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছে তা হলো, আইনে মিথ্যা মামলা করার যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, সে বিধানের অধীনে আসলে কয়টা মামলা নিষ্পত্তি হলো বা বিচারাধীন রয়েছে, সেই সংখ্যা বের করা।


নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধারা ১৭-তে মিথ্যা মামলা বা অভিযোগ দায়ের করার ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে এই ধারার অধীনে মামলা হয় খুবই কম। সুতরাং ধারা ১৭-তে করা মামলাগুলোর সংখ্যা দিয়ে যদি মিথ্যা মামলার পরিস্থিতি বিচার করতে হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মিথ্যা মামলা প্রায় হয়ই না।

নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে শুধু যে ‘অধিকাংশ’ বিশেষণটি যুক্ত হচ্ছে, তা-ও কিন্তু নয়, বেশ কয়েক বছর ধরে এটাও শোনা যাচ্ছে যে নারী নির্যাতন দমন আইনের শতকরা ৮০ ভাগ মামলাই মিথ্যা! এই ৮০ শতাংশের তথ্যটি কেমন করে উদ্ভূত হলো, সেই খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল ২০১৩ সালে তৎকালীন আইনমন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে পত্রিকাগুলো ফলাও করে প্রচার করছে এই শিরোনামে যে আইনমন্ত্রী বলেছেন, নারী নির্যাতন মামলার ৮০ শতাংশই মিথ্যা! এমনকি তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রীও পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী সেই সভায় মন্তব্য করেছিলেন যে বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ মামলায় আসামি খালাস পায়; কারণ, মামলা মিথ্যা হয়। অথচ আসামি খালাস পায় তদন্তে গাফিলতি, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, পাবলিক প্রসিকিউটরের অদক্ষতা, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতাসহ আরও নানা কারণে, যেখানে মিথ্যা মামলার ভূমিকা নগণ্য।

২০১৮ সালে প্রথম আলোর করা একটি সিরিজ অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল যে ঢালাওভাবে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা মিথ্যা, এটি বলার কোনো সুযোগ নেই, বরং উল্টোটাই সত্যি। প্রতিবেদনটিতে যে কয়জন পাবলিক প্রসিকিউটর, পুলিশ কর্মকর্তা আর অভিযোগকারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল, তাঁরাও জানিয়েছিলেন ধর্ষণ, যৌন পীড়নের মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্যি হয়, কিন্তু প্রমাণের অভাবে আসামি খালাস পেয়ে যায়। যদিও এই ৮০ শতাংশ সংখ্যার তথ্যটির কোনো ভিত্তি নেই, কিন্তু গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবারই পত্রপত্রিকায় আলাপ-আলোচনায় ৮০ শতাংশের এই ব্যাপারটি উল্লেখিত হয়েছে নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে। একই সঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী পুলিশ কর্তৃপক্ষও বলছে যে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৮০ শতাংশ মামলারই কোনো প্রমাণ মেলে না। এই বক্তব্যও একইভাবে এটি প্রমাণ করে না যে মামলাগুলো মিথ্যা বলেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। একটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে, আর সে কারণেই পুলিশকে তদন্ত করতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে অভিযোগটির আইনগত ভিত্তি যাচাইয়ের জন্য। এভাবে এ ধরনের সংখ্যা বা বিশেষণ ব্যবহার করতে করতে ভিত্তিহীন হলেও প্রায় প্রমাণিত সত্য হিসেবে স্বীকৃত হয়ে গেছে যে নারী নির্যাতনের মামলা প্রথমত মিথ্যাই হয়।

প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে সারা দেশের ৪০টির বেশি ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার ১ নম্বর কারণ হিসেবে মিথ্যা মামলাকে চিহ্নিত করেছিলেন। যদিও ওই তালিকা আসলে কিসের ভিত্তিতে করা হয়েছিল বা সেই তালিকায় মিথ্যা মামলা বলতে কী ধরা হয়েছিল, সেটি জানার উপায় নেই, তবে ব্যক্তিগতভাবে যে কয়জন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সঙ্গে কথা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে গবেষণার কাজে, তাঁরা প্রত্যেকেই কিন্তু মিথ্যা মামলার সঙ্গে বরং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধারা ১১-এর ‘গ’-এর সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেছেন। ১১-এর ‘গ’ ধারায় একজন নারী পরিবারের কারও দ্বারা যৌতুকের জন্য সাধারণ জখমের শিকার হলে অভিযোগ করতে পারবেন। বিচারকদের কেউ কেউ সেই সম্মেলনের ওপর ভিত্তি করে করা পত্রিকার রিপোর্টের শিরোনামকে সমালোচনা করে বলেছেন, সম্মেলনে মিথ্যা মামলা বলতে ১১-এর ‘গ’ ধারার মামলার কথা বলা হয়েছিল, সব ধারার মামলা নয়।

সম্মেলনে একজন বিচারক তাঁর নিবন্ধে বলেন, ১১-এর ‘গ’ ধারায় শুধু যৌতুকের দাবিতে মারধর করে সাধারণ জখম হওয়ার মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তবে এই মামলাগুলোর ক্ষেত্রে যৌতুকের জন্য জখম হওয়ার উপাদান অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। অর্থাৎ যৌতুকের দাবির কারণে নির্যাতন না করা হলেও অনেক সময় বাদীপক্ষের আইনজীবী মামলার দ্রুত এবং কঠোর প্রতিকারের আশায় যৌতুকের দাবি জুড়ে দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। আর এ কারণেই মামলাটিকে মিথ্যাই বলা যেতে পারে, যদিও সহিংসতার ঘটনা কিন্তু মিথ্যা নয়। যৌতুকের দাবি প্রমাণ করতে না পারায় স্বাভাবিকভাবেই আসামিও খালাস পেয়ে যায়। এটি একটি বেআইনি এবং অনৈতিক পন্থা, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে এই চর্চার পেছনে বড় একটি কারণ হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পারিবারিক নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্তই করছে না।

অর্থাৎ নারীর প্রতি সহিংসতার জন্য ২০০০ সালে যে বিশেষ আইন করা হয়েছে, তা নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনাগুলোকেই বাদ দিয়ে দিচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পারিবারিক নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হলে যৌতুকের দাবির কারণে সহিংসতা হয়েছে এমনটা প্রমাণ করতে হবে। সুতরাং যৌতুকের দাবি ছাড়া শুধু পারিবারিক নির্যাতনের কারণে একজন নারীর যদি মৃত্যুও ঘটে, সেই অপরাধের বিরুদ্ধে কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যাওয়া যাবে না, সাধারণ ফৌজদারি আদালতেই হত্যা মামলা চালিয়ে যেতে হবে।

১১-এর গ ধারায় বেশির ভাগ মামলা আবার আরেকটি কারণে অর্থহীন হয়ে পড়ে শেষমেশ, কেননা দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে মামলার পক্ষদ্বয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আপস হয়ে যাওয়ার কারণে মামলাটি আর এগোচ্ছে না। যেহেতু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কোনো অপরাধই আপসযোগ্য নয়, সুতরাং বিচারককে কিন্তু সেই মামলা চালিয়ে যেতে হচ্ছে এবং চূড়ান্ত রায়ে বলা হচ্ছে যে যেহেতু অপরাধ প্রমাণিত হয়নি, তাই আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হলো। ১১-এর গ ধারায় বেশির ভাগ মামলাকে মিথ্যা ধরে নেওয়ার এটাও একটা কারণ, যদিও সেখানে সহিংসতার অভিযোগটি কিন্তু মূলত ঠিকই ছিল।

নারী নির্যাতনের অভিযোগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এ রকম অপবাদের পেছনে যুগে যুগে নারীকে দমিয়ে রাখা পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক প্রথা ও ধ্যানধারণাকেও ভুলে গেলে চলবে না। যত বেশি প্রচার করা যায় যে নারী নির্যাতনের মামলা সবই মিথ্যা, তত বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় নারীকে, বিশেষ সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে স্থাপিত এই বিশেষ ট্রাইব্যুনালের কার্যকারিতাকেও। তাই তো আমরা পত্রিকায় ধর্ষণের খবর দেখলে তাকে স্বাভাবিকই ধরে নিই, কিন্তু একজন ধর্ষণের শিকার নারী যখন আদালত পর্যন্ত পৌঁছে যান, তখনই তা অস্বাভাবিক ঠেকে। মনে হয়, না জানি কী দুরভিসন্ধি নিয়ে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে ফাঁসানোর চেষ্টায় লিপ্ত এই নারী!

নিরপরাধ ব্যক্তির সম্মানের ভয় আর ধর্ষণের শিকার নারীকে অতিমাত্রায় সন্দেহপূর্বক বিচার করার এই ধারা চালু হয়েছিল সেই ব্রিটিশ আমলের বিচারিক প্রক্রিয়ার সময় থেকে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে ধর্ষণ আর যৌন অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু আমরা যত্নসহকারে ব্রিটিশ শাসক এবং আইনজ্ঞদের বিলাত থেকে আমদানি করা তত্ত্ব দিয়েই পরিমাপ করছি একজন ধর্ষণের শিকার নারীর আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতাকে। এই সন্দেহের বোঝা কিন্তু একজন বিচারপ্রার্থী নারীকে বিচারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বইতে হয়। এ কারণে অন্য অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের ওপর অভিযোগ প্রমাণ করার যে দায়িত্ব থাকে, সহিংসতার শিকার নারীর ওপর সেই দায়িত্ব হয় তার দ্বিগুণ। খুঁটিনাটি তথ্যপ্রমাণ দিয়ে একজন নারীকে তাঁর অভিযোগ প্রমাণ করতে হয় যে তিনি সত্যিই সহিংসতার শিকার, বিশেষ করে সেটি যদি হয় যৌন সহিংসতা। নারীর প্রতি আমরা সহিংসতা কমাতে পারছি না, অন্তত বিচারপ্রার্থী নারীকে সহানুভূতি তো দেখাতে পারি? অভিযুক্তকে যদি সহানুভূতি দেখানো যায়, অপরাধের শিকার নারীকে নয় কেন?

সবশেষে এটি উল্লেখ করা জরুরি যে বিচারপ্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যাঁরা আছেন, তাঁরা আরেকটু সচেতনভাবে শব্দ চয়ন ও প্রয়োগ করবেন, এমনটা আশা করা যেতে পারে, যখন তাঁরা নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার জটিলতা নিয়ে জনসমক্ষে কথা বলবেন। এত বছরের যে ভুল ধারণা সত্যি বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, সেটাকে ভাঙতে সময় লাগবে বটে, তবে শুরুটা করা দরকার।


লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: taslima47@yahoo.com