
সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও চলন্ত ট্রেনে বাইরে থেকে পাথর ছোড়ার ঘটনা থামানো যাচ্ছে না। গত এক বছরে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৫৪টি। এতে সর্বশেষ গত শনিবার রাতে সীতাকুণ্ডে প্রীতি দাশ (২৪) নামের একজন নারী প্রকৌশলী নিহত হন। এর আগে আরও অনেকে আহত হয়েছেন।রেল ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বিকৃত আনন্দ পেতেই দুর্বৃত্তরা বাইরে থেকে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ঢাকার তেজগাঁও থেকে গাজীপুরের টঙ্গী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর, কুমিল্লার ময়নামতি থেকে কুমিল্লা স্টেশন এবং চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত রেললাইনকে বিপজ্জনক বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছেন। রেলওয়ে সূত্র জানায়, সর্বশেষ শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চলন্ত ট্রেনে ছোড়া পাথরের আঘাতে প্রকৌশলী প্রীতি দাশ নিহত হন। এর আগে ১৯৯৭ সালে একজন জেলা নিবন্ধন কর্মকর্তা নিহত হন। ৫ আগস্ট কুমিল্লা স্টেশনের অদূরে ঢাকাগামী মহানগর প্রভাতীর পরিচালক (গার্ড) সাহেব উদ্দিন পাথরের আঘাতে হাঁটুতে জখম হয়েছেন। তিনি এখনো ঢাকা রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত রোববার চট্টগ্রামগামী কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ট্রেনে বাইরে থেকে ছোড়া ঢিলে কাদির মিয়া (৪৫) নামের এক যাত্রী চোখে ও মুখে আঘাত পান। ট্রেনটি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মেথিকান্দা স্টেশন ছেড়ে রামনগর সেতু অতিক্রম করার আগে কে বা কারা ঢিল ছুড়ে মারলে পুরো কামরায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কাদিরের বাড়ি ভৈরবের শিমুলকান্দি গ্রামে।
ঈদের দুই দিন আগে গত বুধবার তিতাস কমিউটার ট্রেনের দুই যাত্রী ঢিলের আঘাতে আহত হন। আখাউড়া থেকে ছেড়ে আশুগঞ্জের তালশহর অতিক্রম করার সময় এ ঘটনা ঘটে। এতে আশুগঞ্জের আড়াইসিধা গ্রামের কল্পনা বেগম (৪০) নামের এক গৃহবধূ আহত হন। অপরজন পুরুষ। তাঁর নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি।
গত ১৯ মার্চ ফৌজদারহাটে পাথর ছুড়ে মেরে সিলেটগামী ট্রেনের কয়েকটি কোচের কাচ ভেঙে দেয়। এতে ৪০ মিনিট দেরিতে ট্রেন গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করে। এর আগে একই জায়গায় কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের ওপর পাথর ছোড়া হয়। তখনো ৪০ মিনিট দেরিতে ট্রেন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
গত ৫ মার্চ কসবা-ইমামবাড়ির মাঝামাঝি জায়গায় দুর্বৃত্তরা তূর্ণা এক্সপ্রেসে পাথর ছুড়ে তিনটি কোচের ছয়টি জানালার কাচ চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। গত ৪ মার্চ সরারচর-মানিকখালী স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় দুর্বৃত্তরা একইভাবে পাথর নিক্ষেপ করে এগারসিন্দুর ট্রেনের কয়েকটি কোচের কাচ ভেঙে দেয়।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ছোড়া পাথরের আঘাতে অনেক যাত্রীর অঙ্গহানি হয়েছে। তবে এর সঠিক পরিসংখ্যান রেল ভবনে নেই। কেউ এসব ব্যাপারে শাস্তি পেয়েছে কি না, তারও কোনো তথ্য নেই পুলিশের কাছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় বলা আছে, চলন্ত ট্রেনে ঢিল বা পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় কেউ আহত হলে অপরাধীর যাবজ্জীবন কিংবা সর্বনিম্ন ১০ বছরের কারাদণ্ড হবে। তবে কেউ মারা গেলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা প্রযোজ্য হবে, যার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।’
গত ১০ বছরে পূর্বাঞ্চলে এমন কোনো ঘটনায় কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়েছে কি না, জানতে চাইলে পুলিশ সুপার নজরুল বলেন, ‘আসলে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এসব ঘটনায় কেউ শাস্তি পেয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই।’
রেলওয়ে সূত্র জানায়, অনেকে অভিযোগ করে না বলে বেশির ভাগ ঘটনা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নজরে আসে না। বড় ঘটনাগুলো কেবল নথিভুক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. তাফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত এক বছরে চলন্ত ট্রেনে বাইরে থেকে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে অর্ধশতাধিক। আমরা প্রতিবছর গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য রেললাইনের আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রচারপত্র বিলি এবং ট্রলিযোগে মাইকিং করে আসছি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে লোকজনকে সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
তাফাজ্জল হোসেন আরও বলেন, ‘নারী প্রকৌশলীর মৃত্যুর ঘটনা সবাইকে নাড়া দিয়েছে। তাই সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আমরা বৈঠক করব, যাতে রেললাইনের পাশের ভবঘুরে কিংবা উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।’
রেলের ভুক্তভোগী একজন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের শিকার আমি নিজেই।’ ক্ষতিগ্রস্ত বাঁ চোখ দেখিয়ে ওই ঠিকাদার বলেন, ‘পাথরের আঘাতে রেলের কোচের কাচ ভেঙে এক টুকরো আমার চোখে ঢোকে। এতে কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর পর থেকে আমি ওই চোখে ঝাপসা দেখি।’
ভুক্তভোগী রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওপিএস) মো. মিয়াজাহান কাটা দাগ দেখিয়ে বলেন, ‘চলন্ত ট্রেনে ছোড়া পাথরে আমার বাম চোখের পাতা ছিঁড়ে গেছে।