Thank you for trying Sticky AMP!!

আন্তরিক সেবায় মেমোরিয়াল খ্রীষ্টান হাসপাতাল

  • হাসপাতালের বহির্বিভাগে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ চিকিৎসা নেয়।

  • বছরে প্রায় দুই হাজারের মতো অস্ত্রোপচার হয় হাসপাতালটিতে।

চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে কক্সবাজার যেতে চকরিয়া উপজেলার মালুমঘাট এলাকায় হাতের ডানে লাল ইটের আধুনিক চারতলা ভবন চোখে পড়ে। এটি মেমোরিয়াল খ্রীষ্টান হাসপাতাল। ভবনটি নতুন, হাসপাতালটি পুরোনো। ১৯৬৬ সালে এই হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন চিকিৎসক, নাম ডা. ভিগো বি অলসেন। বহুল পঠিত ডাক্তার: ডিপ্লোম্যাট ইন বাংলাদেশ তাঁরই লেখা বই। অতিসম্প্রতি তিনি মারা গেছেন।

ভিগো বি অলসেন গত শতকের ষাটের দশকে যখন কাজ শুরু করেছিলেন তখন এই এলাকায় ছিল গভীর জঙ্গল। এলাকায় ম্যালেরিয়া, টাইফয়েডের প্রকোপ ছিল ব্যাপক। দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির চিকিৎসা পাওয়া ছিল দুষ্কর। এখন হাসপাতালটি দুর্ঘটনায়, বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। সড়ক দুর্ঘটনা হলেই কক্সবাজার-চট্টগ্রাম এলাকার মানুষ প্রথমেই এই হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভাবে।

হাসপাতালটি গড়ে উঠেছিল জঙ্গল কেটে। দশকের পর দশক আন্তরিক সেবা দিয়ে অর্জন করেছে মানুষের আস্থা।

হাসপাতালটি পরিচালিত হয় খ্রিষ্টান মিশনের মাধ্যমে। প্রথমে হাসপাতাল স্থাপিত হয় বনের জায়গা ইজারা নিয়ে। পরে সরকার হাসপাতালকে ২৫ একর জমি দেয়। গত সোমবার এই হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, বর্তমান চারতলা ভবনে হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০২০ সালে। প্রতিষ্ঠানের পুরোনো স্থাপনা এখনো আছে। হাসপাতালে ঢোকা, বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, অর্থ পরিশোধ করা—সবকিছুতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ছাপ। ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে পাঁচজন চিকিৎসক আছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিদেশি। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চিকিৎসক সবাই যুক্তরাষ্ট্রের। তবে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ে-কমে।

হাসপাতালের বহির্বিভাগে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ চিকিৎসা নেয়। আর বছরে প্রায় দুই হাজারের মতো অস্ত্রোপচার হয়। আশির দশকে কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, সেবার মান কত উন্নত হতে পারে, সেবা কত আন্তরিকতার সঙ্গে দেওয়া যায়, তা ওই হাসপাতালে না গেলে তিনি উপলব্ধি করতে পারতেন না।

হাসপাতালটি একটু আলাদা

চিকিৎসা, নার্সিং, ব্যবস্থাপনা, যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ, মেরামতসহ সব শাখার প্রধান বিদেশি। দেশে চিকিৎসকের কমতি নেই। কিন্তু হাসপাতালে কোনো বাংলাদেশি চিকিৎসক পাওয়া গেল না। কারণ জানতে চাইলে হাসপাতালের সহকারী প্রশাসক যোসেফ অমূল্য রায় প্রথম আলোকে বলেন, এই হাসপাতালে যাঁরা চিকিৎসাসেবার (চিকিৎসক ও নার্স) সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, তাঁরা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবেন না। এই শর্ত অনেকে মানতে চান না, অনেকে শর্ত ভাঙেন।

হাসপাতালের চিকিৎসক হেদার ফাউলার প্রতিদিন ভোরে হাসপাতালে ঢোকেন। ভর্তি থাকা সব রোগীর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। এরপর তিনি বহির্বিভাগে রোগী দেখা শুরু করেন। হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এই ধরনের নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক কম দেখা যায়। চিকিৎসক ও নার্সদের সেবা দেওয়ার এই মানসিকতার কারণে এলাকার মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে এই হাসপাতাল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হাসপাতালের বিদেশি চিকিৎসকদের থাকা অসম্ভব হয়ে পড়িছিল। ভিগো বি অলসেনসহ অন্যরা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তখনো সীমিত জনবল দিয়ে চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রেখেছিল এই হাসপাতাল। করোনা মহামারির সময়ও তারা চিকিৎসা দিয়েছে। মহামারির সময় কারও চাকরি যায়নি, কারও বেতন কাটা হয়নি।

বরুণ দাসের জন্ম এই হাসপাতালে। এখন তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা। হাসপাতালের বিভিন্ন তলা ও ওয়ার্ড দেখানোর সময় বরুণ দাস এই প্রতিবেদককে বলেন, হাসপাতালে সংক্রমণ যেন না ছড়ায়, সে ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া আছে।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সব সময় খোলা থাকে। যেকোনো আঘাত বা দুর্ঘটনার রোগী এলে তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না হলে রোগীকে দ্রুত অন্য হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এই হাসপাতালের বিশেষ দক্ষতা আছে জেনারেল সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারি এবং প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ চিকিৎসায়। নিরাপদ প্রসবের জন্য এলাকার মানুষের ভরসার জায়গা এই মেমোরিয়াল খ্রীষ্টান হাসপাতাল।

হাসপাতালটি ছোট, তবু এর আছে নিজস্ব হেলিপ্যাড। কোনো রোগীকে কেউ যদি দ্রুত আনতে চান অথবা হাসপাতালে ভর্তি রোগীকে কেউ যদি অন্য হাসপাতালে নিতে চান, তাহলে তাঁরা হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে পারেন।

হাসপাতালের চৌহদ্দির মধ্যে আছে নিজস্ব ওয়ার্কশপ। এর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি বা যানবাহন মেরামত করার মতো প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মী আছে ওই ওয়ার্কশপে। কর্মীরা প্রত্যেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

হাসপাতালে বিদেশি যাঁরা চিকিৎসা ও সেবার সঙ্গে জড়িত তাঁদের প্রত্যেককে বাংলা শিখতে হয়, রোগীর সঙ্গে তাঁদের বাংলাতেই কথা বলতে হয়।

তাঁরা একটি পরিবার

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মনে করে, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মালি, চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান সবাই হাসপাতালের জন্য অপরিহার্য। উন্নত সেবার জন্য সবারই ভূমিকা আছে। তাই এখানে সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী সম্মান পান। এটা চোখে পড়ে চৌহদ্দির ভেতরের থাকা ক্যানটিনে গেলে। এক টেবিলে বিদেশি জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে অন্যরাও চা-কফি পান করেন, শিঙাড়া খান।

হাসপাতালের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর স্বাস্থ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় কর্তৃপক্ষ। প্রতি সপ্তাহে রবি, সোম ও বৃহস্পতিবার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

সুজান এজ এখন হাসপাতালের প্রশাসক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রেজিস্টার্ড নার্স। এই হাসপাতালে এসেছিলেন ১৯৯০ সালে। মেমোরিয়াল খ্রীষ্টান হাসপাতালের অনন্যতা বা বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সুজান এজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালের আমরা সবাই একটি পরিবারের মতো, বড় পরিবার। আমরা প্রত্যেকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করি। আমরা কেউ এখানে চাকরি করি না, আমরা এখানে মানুষের সেবা করি।’