
জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সদস্যদের ঘোরতর আপত্তির মুখে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য করা বিশেষ আইনের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে বিল পাস হয়েছে। সরকার বলছে, নির্ভরযোগ্য, নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী বিদ্যুতের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
মেয়াদ বাড়ানোর বিরোধিতা করে বিরোধী দলের সদস্যরা বলেছেন, এ সরকারের আমলে যে কয়টি খাতে হরিলুট হয়েছে, তার মধ্যে বিদ্যুৎ খাত অন্যতম। এখানে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। ফলে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিছু মানুষকে সুবিধা দেওয়ার জন্য পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এটার প্রয়োজন নেই।
বিরোধী দলের সাংসদেরা বলেন, সরকারই দাবি করছে, এখন চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। তাহলে কেন আবার কুইক রেন্টালের মেয়াদ বাড়াতে হবে? জনগণের করের টাকা অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। অবশ্য এসব আপত্তি টেকেনি। কণ্ঠভোটে শেষ পর্যন্ত বিলটি পাস হয়েছে। ফলে আরও পাঁচ বছর রেন্টাল–কুইক রেন্টাল চালাতে আইনি বাধা থাকবে না।
দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে ২০১০ সালে বিশেষ বিধান রেখে সাময়িক একটি আইন করেছিল সরকার। কয়েক দফা আইনের মেয়াদ বাড়িয়ে তা ২০২১ পর্যন্ত করা হয়। আজ বৃহস্পতিবার ‘বিদ্যুৎ ও জ্বলানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) বিল-২০২১’ আইনটির মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়।
বিলটির বিরোধিতা করে গণফোরামের সাংসদ মোকাব্বির খান বলেন, যে কয়টি খাতে হরিলুট হয়েছে এ সরকারের আমলে, তার মধ্যে বিদ্যুৎ খাত অন্যতম। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। কিন্তু এ আইনের কারণে বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। ফলে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, তড়িঘড়ি করে বিলটি সংসদে আনা হয়েছে। এ বিলের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য আছে। কোনোভাবেই এটি পাস করা উচিত হবে না। ভয়াবহ সংকট ছিল ২০১০ সালে। এখন বিদ্যুতের ঘাটতি নেই। ফলে এ বিলেরও প্রয়োজন নেই।
বিলটির বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক বলেন, মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না। ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎই ব্যবহার করতে পারছে না সরকার। আগে বিতরণ লাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, এত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুফল তাঁর এলাকার মানুষ পায়নি। গরমের সময় পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। কোনো মানুষ ঘুমাতে পারে না। এলাকার মানুষ অবস্থান ধর্মঘট করেছেন। পল্লী বিদ্যুৎ একেক সময় একেক কথা বলে। বিদ্যুৎ যাতে ২৪ ঘণ্টা পাওয়া যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
জাতীয় পার্টির আরেক সাংসদ শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, সাময়িক সময়ের জন্য এ আইন। এখন সরকার দাবি করছে, শতভাগ বিদ্যুৎ হয়ে গেছে অনেক জায়গায়। এ আইনের মেয়াদ বাড়িয়ে সরকারই স্বীকার করছে বিদ্যুতের ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকায় বিদ্যুৎ থাকে না। বিদ্যুৎ আসে, না যায়, তা বোঝা যায় না।
বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, এ আইনের কালো বিষয় হলো কোনো আদেশ–নির্দেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। ২০১০ সালে বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল। ঘাটতি জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে মেটানো হয়েছে। কিন্তু পাঁচ বছর কেন মেয়াদ বাড়ানো হবে? তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরে কত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে? অতিরিক্ত বিদ্যুৎ কি বিদেশে রপ্তানি করা যাবে?
বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, এ বিলের মাধ্যমে সরকার স্বীকার করে নিয়েছে যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির তীব্র ঘাটতি আছে। ইনডেমনিটি নিয়ে এ আইন করা হয়েছিল। দায়মুক্তি নির্দেশ করে হরিলুট, বীভৎস দুর্নীতির মাধ্যমে কিছু মানুষের হাতে টাকা তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন তোলা যাবে না।
বিএনপির সাংসদ মোশাররফ বলেন, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ আসে, কখন চলে যায় মানুষ টেরও পায় না। আকাশে মেঘ করলে বিদ্যুৎ থাকে না। দুই ফোঁটা বৃষ্টি পড়া শুরু হলে বিদ্যুৎ চলে যায়। ফেসবুকে মানুষ এত বাজেভাবে কথা বলে, খারাপ লাগে।
জাতীয় পার্টির সাংসদ পীর ফজলুর রহমান বলেন, যখন চাহিদার চেয়ে অনেক কম বিদ্যুৎ ছিল, বিদ্যুতের জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে, সে সময় কুইক রেন্টালের প্রয়োজন ছিল। এ মুহূর্তে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ বেশি আছে। সেখানে কেন এত ব্যয়বহুল কুইক রেন্টালের সময় বাড়াতে হবে?
সাংসদদের বক্তব্যের জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, তথ্যগত ভুলের কারণে অনেকে বুঝতে পারছেন না। বিলটি চলমান। কেবল সময় বাড়ানো হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্ভরযোগ্য, নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী বিদ্যুতের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ২৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা আছে। এর মধ্যে সাড়ে চার হাজার কেপটিভ পাওয়ার। এগুলো গ্যাস দিয়ে বিভিন্ন ইন্ড্রাস্ট্রি তাদের জন্য উৎপাদন করে। ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট ভারত থেকে আমদানি করা হয়। ১০ শতাংশ ডিরেটেড ক্যাপাসিটি, তাহলে হাতে থাকল ১৮ হাজার মেগাওয়াট। আরও দেড় হাজার মেগাওযাটের মতো পুরো সময় মেইনটেন্যান্সের মধ্যে থাকতে হয়। তাহলে হাতে থাকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। দেওয়া হচ্ছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট।