উফ! মায়ের কাছে সন্তানের মৃত্যু কী যে কষ্টের

জেসমিন আকতার
জেসমিন আকতার

জেসমিন আকতার বলছিলেন, ‘উফ! মায়ের কাছে সন্তানের মৃত্যু যে কী কষ্টের তা আমি জানি। গর্ভধারণের ৩৫ সপ্তাহে পেটের মধ্যে সন্তান মারা গেল। ২০০৪ সালে শুধু মৃত ছেলের শরীরটা একটু ছুঁয়ে দেখেছিলাম। সেই ছোঁয়ার অনুভব এখনো স্পষ্ট।’
কথাগুলো বলার সময় সেবা পরিদপ্তরের মিডওয়াইফারি কর্মকর্তা জেসমিন আকতারের দুই চোখ ছলছল করতে থাকে। একটু আগেই এই নারীর চোখে ছিল খুশির ঝিলিক। পৃথিবীতে মায়ের পেট থেকে নবজাতকের আগমনকে একটু সহজ করে দিয়ে মায়ের মুখে হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে পেয়েছেন ‘মিডওয়াইভস ফর অল’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক পুরস্কার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই তাঁকে এটি অর্জন করতে হয়েছে। সুইডেনের পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অব মিডওয়াইভসের ‘মিডওয়াইভস ফর অল’ ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশি হিসেবে তিনি দ্বিতীয়। তবে এ পেশায় এটিই জেসমিনের প্রথম পুরস্কার অর্জন।
জেসমিন আকতারের সঙ্গে কথা হয় বাংলা একাডেমিতে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক ‘সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রডাকটিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস’ বিষয়ক জাতীয় সম্মেলনের শেষ দিনে বাংলাদেশে সুইডেন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত জন ফ্রিসেল, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) দেশীয় প্রতিনিধি আর্জেন্টিনা মাতাভেল পিচ্চিনসহ অন্য অতিথিরা জেসমিন আকতারের হাতে বাঁধাই করা একটি সনদ তুলে দেন। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনের আয়োজন করে সুইডেন ও নেদারল্যান্ডস দূতাবাস, ইউএনএফপিএ এবং জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। 

জেসমিন বলেন, ‘গর্ভধারণের ৩৭ সপ্তাহে নবজাতক পৃথিবীর আলো দেখে। আর আমার ছিল ৩৫ সপ্তাহ। আমি বলেছিলাম, আমার সন্তান নাড়াচাড়া করছে না। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। চিকিৎসক দেখে জানান, সব ঠিক আছে। অথচ অস্ত্রোপচারের আগের দিন আমাকে জানানো হয়, আমার ছেলে মারা গেছে।’
জেসমিন আকতার বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স। ইউএনএফপিএর সহায়তায় তৈরি মিডওয়াইফারি ইউনিটে প্রেষণে মিডওয়াইফারি কর্মকর্তা হিসেবে সেবা পরিদপ্তরে কাজ করছেন। মিডওয়াইভদের প্রশিক্ষক তিনি। মিডওয়াইফারি পেশাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করছেন। বিভিন্ন হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা ১৮ বছরের।
খুলনার মেয়ে জেসমিন ১৯৯৩ সালে খুলনা নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে চার বছরের ডিপ্লোমা নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্স শেষ করেন। সে বছরই তিনি বিয়ে করেন। মিডওয়াইফারি বিষয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। ২০১০ সালে জাপান থেকে ‘সেফ মাদারহুড’ বিষয়ে আরেকটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন। ছেলে ইফতেখারুল ইসলাম এবং মেয়ে ইফরাত ইসলামের মা তিনি।
জেসমিন জানালেন, দেশে মিডওয়াইফারি পেশাটা নতুন। ২০১৩ সাল থেকে শুধু মিডওয়াইফারি বিষয়ে তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে তিন হাজার পদ সৃষ্টি করেছে সরকার। বর্তমানে নার্সদের মধ্য থেকে ১ হাজার ৪৮৬ জনের মধ্যে (ছয় মাসের অ্যাডভান্স মিডওয়াইফারি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন) ৬০০ জনের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরও ৬০০ জন নিয়োগের অপেক্ষায়। অন্যদিকে মিডওয়াইফারি কোর্স সমাপ্ত করা প্রথম ব্যাচের ৫৯৭ জন চাকরির অপেক্ষায় আছেন।
নার্সিং পেশায় আসার পেছনে যাঁর অবদান, তিনি হলেন জেসমিনের শ্বশুর। শাশুড়ির তীব্র আপত্তির মুখে শ্বশুর জিতে যান। ১৯৯৮ সালে প্রথম সরকারি চাকরিতে যোগ দেন জেসমিন। এর আগে নার্সিং পড়ার জন্য নিজের বাবা ও পরিবারের অন্যদের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হয়।
জেসমনি বলেন, ‘শাশুড়ি মারা যাওয়ার আগে বলে গেছেন, তিনি আমাকে নার্স হতে না দিতে চেয়ে ভুল করেছিলেন।’ জেসমিনের চোখে আবার খুশির ঝিলিক। তিনি জানালেন, এখন নার্স বা মিডওয়াইফারি কোর্সে হাজার হাজার মেয়ে আবেদন করছেন। তার মানে এ পেশা নিয়ে সমাজে যে একধরনের নেতিবাচক ধারণা ছিল, তা আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাজের অভিজ্ঞতায় জেসমিন বলেন, এখনো বেশির ভাগ গর্ভবতী মাকে খুব খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও নার্সদের করার কিছুই থাকে না।
জেসমিন বলেন, ‘কোনো কোনো নবজাতক মাথা বের করে আমাকে ডাকে। আবার কাউকে বের করতে বেশ কৌশল অবলম্বন করতে হয়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে জানতে পেরেছি, প্রসবের সময় মায়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হয়। অনেক কষ্টের পর যখন নবজাতককে বের করে মায়ের বুকে দিই, তখন মা সব ব্যথার কথা ভুলে যান। সন্তানকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাসি দেন। সে হাসি যে কেমন, তা কেউ না দেখলে বুঝতে পারবেন না।’
জেসমিনের স্বপ্ন গর্ভধারণ, প্রসব, প্রসব-পরবর্তী এবং নবজাতকের ৪২ দিন পর্যন্ত সেবা দেওয়ার জন্য প্রতিটি মা হাতের কাছে মিডওয়াইফারিদের পাবেন।
কথা শেষ হওয়ার পর দেখা গেল ইউএই এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা জেসমিনের স্বামী অহিদুল ইসলাম একটি ফুলের তোড়া নিয়ে বাংলা একাডেমিতে হাজির। তিনি লাজুক হেসে বললেন, ‘আমি জানি, আমার স্ত্রী তাঁর পেশায় খুব ভালো করছেন। আরও একটু ভালো করার জন্য যেটুকু সহযোগিতা করা প্রয়োজন এবং আমার পক্ষে যেটুকু করা সম্ভব, তা করার চেষ্টা করি।’