Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনাকালে টেলিমেডিসিনই মানুষের বড় ভরসা

করোনাকালে মানুষের প্রধান সহায় হয়ে উঠেছে টেলিমেডিসিন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারির সময় চিকিৎসার সেরা বিকল্প টেলিমেডিসিন। করোনা রোগীরা হাসপাতালের চেয়ে বেশি সেবা পাচ্ছেন এই বিকল্প পন্থায়।

মহামারির সময় চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সংক্রমণভীতি। হাসপাতাল বা চিকিৎসকের চেম্বারে ঝুঁকি বেশি—এই বিবেচনায় রোগীরা এসব স্থানে যেতে চাচ্ছেন না। কিন্তু চিকিৎসা তাঁদের দরকার। অন্যদিকে উপযুক্ত পরিবেশ ও যথাযথ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর ঘাটতি থাকায় সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে না আসাকে উচিত বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। তবে তাঁরাও চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখতে চান।

টেলিমেডিসিন নতুন নয়। অতীতে পরিচিত চিকিৎসকের কাছ থেকে মানুষ টেলিফোনে নানা পরামর্শ নিতেন। মুঠোফোন চালু হওয়ার পর থেকে মানুষ রোগব্যাধিতে পরামর্শ পাওয়ার পাশাপাশি খুদে বার্তায় ব্যবস্থাপত্র পেতে শুরু করেন। চিকিৎসাপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এর সুবিধা নিচ্ছেন চিকিৎসক ও রোগীরা। কিন্তু এটা এত দিন ছিল বিকল্প ব্যবস্থা। মহামারির সময় বেশি মানুষের কাছে প্রধান ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে টেলিমেডিসিন।

গতকাল নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, ২৪ ঘণ্টায় ১ লাখ ৯০ হাজার ৫৯৯টি ফোনকল এসেছে করোনা চিকিৎসা নিতে বা করোনা বিষয়ে জানতে। এই কলগুলো এসেছে ৩৩৩, স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩ এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) নম্বরগুলোতে।

করোনা চিকিৎসার জন্য মানুষ ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার—এসব ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। করোনায় আক্রান্ত রোগী কলসেন্টারে, হাসপাতালে, চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে অথবা সরাসরি চিকিৎসকের কাছে ফোন করছেন। চিকিৎসক রোগীর সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন, কখনো এক্স–রে বা পরীক্ষার সুপারিশ করছেন। রোগী পরীক্ষার ফলাফল ম্যাসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে বা ই–মেইলে পাঠাচ্ছেন। চিকিৎসকও সেই মাধ্যম ব্যবহার করে ব্যবস্থাপত্র পাঠাচ্ছেন।

কোন পরীক্ষা কোথায় করা যাবে, কোন ওষুধ কোথায় পাওয়া যাবে, তারও পরামর্শ থাকে কিছু ব্যবস্থাপত্রে।

বিশিষ্ট বক্ষব্যাধি চিকিৎসক এবং জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক রাশেদুল হাসান বলেন, ‘রোগীকে সরাসরি দেখে চিকিৎসা দেওয়া এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিকিৎসা দেওয়ার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। মহামারি পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম বিকল্প টেলিমেডিসিন।’ অধ্যাপক রাশেদুল হাসান, সরাসরি করোনা রোগী দেখছেন, মুঠোফোনে রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন এবং ফেসবুকে করোনা চিকিৎসার বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন।

প্রতিটি রোগের জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসাবিধি (ট্রিটমেন্ট প্রটোকল) আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে দেশেও করোনা চিকিৎসা নির্দেশনা তৈরি হয়েছে। অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, সেই নির্দেশনা মেনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা হচ্ছে না। যদিও এই নির্দেশনায় টেলিমেডিসিন বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই।

টেলিমেডিসিন সেবার বিষয়ে জাতীয়ভাবে কোনো নির্দেশনা নেই। তাই এ ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসা হওয়ারও আশঙ্কা আছে। এ ধরনের বিধি ও নির্দেশনা তৈরি এবং তা বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। বিএমডিসির সভাপতি ও করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিধিমালা তৈরির কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। ১০–১২ দিনের মধ্যে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি টেলিমেডিসিনসেবা দিতে চাইলে তাকে বিএমডিসির অনুমোদন নিতে হবে।’

সরকারি ব্যবস্থা

সরকারি হিসাব বলছে, দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত ৩৩৩, ১৬২৬৩ ও আইইডিসিআরে ১ কোটি ৫২ লাখের বেশি ফোন এসেছে সেবা পাওয়ার জন্য। আর সবশেষ এক দিনে ফোন এসেছে ১ লাখ ৯০ হাজারের বেশি।

দেশে রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১ লাখ ৭২ হাজার ১৩৪ জন। তাঁদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৮০ হাজার ৮৩৮ জন। মারা গেছেন ২ হাজার ১৯৭ জন। হাসপাতালে ও আইসোলেশন সেন্টারে সেবা নিচ্ছেন প্রায় ২০ হাজার। বাকি ৬৯ হাজার বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

বাড়িতে সেবা যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁদের একটি অংশ সরকারি তিনটি কলসেন্টার থেকে সেবা নিচ্ছে। এই কলসেন্টারে ২৪ ঘণ্টা সেবা পাওয়া যায়।

এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ৪৮২টি হাসপাতাল থেকে করোনার টেলিমিডিসিনসেবা দেওয়া হচ্ছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নম্বরে ফোন করে একজন মেডিকেল কর্মকর্তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, মুঠোফোন নম্বরটি এলাকায় মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দৈনিক ১০ থেকে ১২টি কল আসে করোনা বিষয়ে জানতে। তবে পাশের উপজেলায় ফোন করে জানা যায়, ফোনটি ব্যবহার করছেন উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অ্যাম্বুলেন্সের চালক।

>চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীকে যুক্ত রেখেছে টেলিমেডিসিন। এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এই সেবার ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।

নতুন উদ্যোগ

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এটুআইয়ের উদ্যোগে এবং সিনোসিস আইটির কারিগরি সহায়তায় কোভিড–১৯ টেলি হেলথ সার্ভিস ইউনিট চালু করেছে স্বাস্থ্য বাতায়ন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এই ইউনিটে পজিটিভ রোগীদের মুঠোফোন নম্বর পাঠানো হয়। চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি আরও কিছু সেবা দেওয়ার কথা আছে। এর মধ্যে রয়েছে জরুরি খাবারের ব্যবস্থা, বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহ, খাবার ও ক্রয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া, জরুরি হাসপাতালের ব্যবস্থা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থা, অ্যাম্বুলেন্সসেবা এবং দাফন/সৎকার ব্যবস্থায় সহায়তা করা।

স্বাস্থ্য বাতায়নের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চিকিৎসক নিজাম উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি পালায় ৩৫ জন চিকিৎসক ও ১০ জন স্বাস্থ্য তথ্য কর্মকর্তা কাজ করেন। ১৩ জুন পরীক্ষামূলকভাবে কাজ শুরু হয়। ১৭ জুন থেকে পুরোদমে কাজ চলছে। এ পর্যন্ত ৫৮ হাজার পজিটিভ রোগীকে তাঁরা নানা ধরনের সেবা দিয়েছেন।

বেসরকারি ব্যবস্থা

চিকিৎসকদের নানা সংগঠন, ক্লাব, বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসকেরা ব্যক্তিগতভাবে করোনা রোগীদের টেলিমেডিসিনসেবা দিচ্ছেন। অনেকে অর্থের বিনিময়ে, কেউ বিনা মূল্যে। কীভাবে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হবে, তা–ও সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। সরকার ২৭টি বেসরকারি সংগঠনের তালিকা https://corona.gov.bd/telemedicine এই ওয়েবসাইটে দিয়েছে।

গতকাল ওই তালিকার একটি ওয়েবসাইটে দেওয়া সব কটি মুঠোফোন নম্বরে এই প্রতিবেদক দুবার করে ফোন করেছিলেন। কেউ ফোন ধরেননি।

অলঅয়েল ডিজিটাল হাসপাতালে ফোন করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, সাধারণ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি তালিকা আছে। রোগীর সঙ্গে তাঁরা চিকিৎসকদের যুক্ত করে দেন। প্রতিবার চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট ফি আছে।

ঝুঁকিমুক্ত নয়

মে মাসের শেষ সপ্তাহে রাজধানীর বাংলামোটর এলাকার এক ব্যক্তির করোনা শনাক্ত হয়। তিনি যোগাযোগ করেন একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। বিশেষজ্ঞ তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপে ব্যবস্থাপত্র পাঠান। জানা গেছে, ওই ব্যবস্থাপত্র দেখে অন্য একজন রোগী ওষুধ খাওয়া শুরু করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক বলেছেন, এ রকম উদাহরণ আরও আছে। এটা বিপজ্জনক প্রবণতা।

অন্যদিকে অধ্যাপক রাশেদুল হাসান বলেন, রোগীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে, তার শরীর স্পর্শ করে চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই। এসব করেও অনেক সময় সঠিকভাবে রোগনির্ণয় করা সম্ভব হয় না। সুতরাং রোগীর সঙ্গে শুধু টেলিফোনে কথা বলে ওষুধ দেওয়ার ঝুঁকি তো আছেই, তবে রোগী ও চিকিৎসক—দুপক্ষই প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হলে ঝুঁকি কমবে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, মুঠোফোনে বা ভিডিও কলে রোগীকে সব সময় প্রশ্ন বোঝানো সম্ভব হয় না। প্রশ্ন করে ঠিক উত্তরটি বের করে আনাও কঠিন। সে ক্ষেত্রে অনেক সময় অনুমাননির্ভর চিকিৎসা হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

করণীয়

এ ব্যাপারে করণীয় অনেক কিছুই আছে। বিএমডিসির সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, টেলিমেডিসিন নীতিমালা চূড়ান্ত হলে তা ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। টেলিমেডিসিন সেবার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব গণমাধ্যমেরও আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব চিকিৎসকের দুই–চার বছরের রোগী দেখার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তাঁরা এই সেবা দিলে ঝুঁকি বাড়বে। একাধিক রোগ থাকা করোনা রোগীদের টেলিমেডিসিনসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। এই সেবার ব্যয়েরও মূল্যায়ন হওয়া দরকার।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, টেলিমেডিসিনের ঝুঁকির বিষয়গুলো জরুরি ভিত্তিতে চিহ্নিত করে তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে কতটা আরোগ্য সম্ভব, তা–ও মূল্যায়ন দরকার।