Thank you for trying Sticky AMP!!

কেনাকাটার আরেক কেলেঙ্কারি

প্রকল্পের আওতায় কেনা আসবাব ও যন্ত্রপাতির দাম বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

স্বাস্থ্য খাতে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ঘটেছে আরেক কেলেঙ্কারি। সব ধরনের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে অস্বাভাবিক ব্যয়ে কেনা হয়েছে আসবাব ও যন্ত্রপাতি। রক্তের রোগ থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের যন্ত্র কেনা হয়েছে বরাদ্দের প্রায় আট গুণ বেশি ব্যয়ে।

অ্যানেসথেসিয়া ভেন্টিলেটর নামের একটি চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা, কিন্তু কেনা হয়েছে প্রায় ১২ গুণ বেশি খরচে। এমনকি যেসব যন্ত্রপাতি কেনারই কথা ছিল না, সেসবও কেনা হয়েছে।

এক প্রকল্পে এত অনিয়ম দেখে পরিকল্পনা কমিশনও বিস্মিত। এভাবে ব্যয় করাকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলছে কমিশন। বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, এটা তো পুকুরচুরি নয়, সাগরচুরিকেও হার মানিয়েছে।

এ জন্য যদি জেল–ফাঁসি হয়ে থাকে, তাহলে কী করার আছে
অধ্যাপক মো. আসাদ, প্রকল্প পরিচালক ও অধ্যক্ষ

স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটার অনিয়মের এ ঘটনা গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৯২৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ৭ তলা হাসপাতাল ভবনকে ১৫ তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা। আরও ছিল কলেজের একাডেমিক ভবন ও শিক্ষার্থীদের জন্য ডরমিটরি নির্মাণ।

আগামী জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৪০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকল্পের সময় আরও দুই বছর এবং ব্যয় ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকায় উন্নীত করতে গত ২৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে তখনই কেনাকাটায় এসব অনিয়ম ধরা পড়ে।

করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা সামনে এসেছে। বেশি দামে নকল মাস্ক কেনা, পরীক্ষা না করেই করোনা রিপোর্ট দেওয়া, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালকের বিপুল সম্পদের খোঁজ পাওয়াসহ নানা কেলেঙ্কারি সামনে আসে। এবার এল শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেলের ঘটনাটি।

কেনাকাটায় যত অনিয়ম

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, রক্তের রোগ থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ে পরীক্ষার জন্য একটি ইলেকট্রোফোরিসেস হিমোগ্লোবিন যন্ত্র কিনতে খরচ ধরা হয়েছিল ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। কিন্তু নেদারল্যান্ডস থেকে তা কেনা হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকায়। অর্থাৎ প্রায় আট গুণ বেশি ব্যয়ে যন্ত্রটি কেনা হয়েছে। বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ করে জানা গেছে, সেখানে এ ধরনের একটি যন্ত্র আছে।

ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা রকিব হাসান জানালেন, এই যন্ত্রের দাম ২০ লাখ টাকার মধ্যে।

আবার একটি অ্যানেসথেসিয়া ভেন্টিলেটরের দাম ধরা ছিল ৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা। কিন্তু যুক্তরাজ্য থেকে ভেন্টিলেটর কেনা হয়েছে ১২ গুণ বেশি দামে, ৫৭ লাখ ২৯ হাজার টাকায়। চোখে ছানি পড়ার পর লেন্স লাগানোর কাজে ব্যবহৃত হয় ফ্যাকো ইমালসিফায়ার। এটি আমদানিতে খরচ ধরা হয়েছিল ২০ লাখ টাকা, কিন্তু কেনা হয়েছে ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকায়। প্রকল্পে ১২টি আইসিইউ ভেন্টিলেটর আমদানি করার কথা, দাম ধরা ছিল প্রতিটি ৫ লাখ টাকা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা প্রতিটি আইসিইউ ভেন্টিলেটরের পেছনে খরচ পড়েছে ৪৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ আট গুণ বেশি দামে ভেন্টিলেটর কেনা হয়েছে।

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

আবার এই প্রকল্পে কেনাকাটার কথা ছিল না, সেসবও কেনা হয়েছে বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে। যেমন অর্থ বরাদ্দ না থাকলেও টেবিল ফর গাইনোকোলজি কেনা হয়েছে ৩১ লাখ ৮৯ হাজার টাকায়। একইভাবে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে কালার ডপলার আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন উইথ ফোরডি, ৫ লাখ ৫২ হাজার টাকায় পালস অক্সিমিটার ডেস্কটপ এবং ৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকায় ইসিআর ল্যাব অটোমেশন।

এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব, সদ্য বিদায়ী) আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘একনেকের অনুমোদন ছাড়া বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে আসবাব ও যন্ত্রপাতি কেনার ঘটনা সরাসরি সরকারের আর্থিক ক্ষতি। আমরা প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আপনি বেশি দামে যেসব যন্ত্রপাতি কিনেছেন, টাকা পেয়েছেন কোথায়? তখন পিডি বলেছেন, অন্য খাত থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এমনটা করার কোনো সুযোগ নেই।’

আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, অনিয়মের বিষয়ে কেউ দায় এড়াতে পারেন না। অনিয়মের আওতায় এসব বিল হিসাব বিভাগ কীভাবে অনুমোদন করেছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারা এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তা খুঁজে বের করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।

দাম কতটা অস্বাভাবিক

পরিকল্পনা কমিশন যেসব যন্ত্রপাতি অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটার কথা বলছে, সেটি আসলে কতটা যৌক্তিক, তা পর্যবেক্ষণে সমজাতীয় একটি প্রকল্প বিশ্লেষণ করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের ঋণে করোনা প্রতিরোধে নেওয়া ‘কোভিড–১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্পটির আওতায় বেশ কিছু স্বাস্থ্য সরঞ্জাম আমদানি করা হয়েছে এ বছর। এ প্রকল্পের আওতায় মোট ৩০০টি আইসিইউ ভেন্টিলেটর আমদানিতে প্রতিটির পেছনে বরাদ্দ ছিল ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৩৭০টি কার্ডিয়াক মনিটর আমদানিতে বরাদ্দ ছিল প্রতিটিতে ৫ লাখ টাকা। প্রতিটি ইসিজি মেশিন (১২ চ্যানেল) আমদানিতে বরাদ্দ ছিল দুই লাখ টাকা। প্রতিটি উচ্চতা ও ওজন মাপার যন্ত্র কিনতে খরচ ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার টাকা।

কেনাকাটায় অনিয়ম বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক ও অধ্যক্ষ মো. আসাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মূল প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) কাঠামোগত অনেক দুর্বলতা ছিল। সেখানে কপি-পেস্ট করা হয়েছে, উপকরণের সঠিক দামের প্রতিফলন হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘যন্ত্রপাতি কিনতে নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে এটা ঠিক, তবে আমি ভালো কিছু করার চেষ্টা করেছি। যন্ত্রপাতির মান রক্ষার চেষ্টা করেছি।’ মূল প্রকল্পে অনেক যন্ত্রপাতির নাম ছিল না, এরপরও কেন কেনা হলো, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মানছি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। কিন্তু চেষ্টা করেছি ভালো যন্ত্রপাতি আনার জন্য। সে জন্য দামটাও বেশি পড়েছে। এ জন্য যদি জেল–ফাঁসি হয়ে থাকে, তাহলে কী করার আছে।’

তবে প্রকল্প পরিচালক ও অধ্যক্ষের এ বক্তব্য মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) কর্মকর্তারা বলছেন, যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় কিঞ্চিৎ এদিকে–সেদিক হতে পারে, কিন্তু এত বিশাল পার্থক্য হতে পারে না। যদি বাজেটের মধ্যে না হয়, তাহলে তাকে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে বলতে হবে। কিন্তু এখানে এসব নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয়নি।


‘জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে’


সামগ্রিক বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবির) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় যে তথ্য শুনিয়েছেন, এটা তো পুকুরচুরি নয়, রীতিমতো সাগরচুরিকেও হার মানিয়েছে। আমাদের দেশে উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ বানানোর একটা মাধ্যম হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মিলেমেশে এই নিজেদের সম্পদ বিকশিত করছে।’

তিনি আরও বলেন, যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়মের যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি সরকারি অর্থ। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে কেনাকাটার অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখা। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনেরও (দুদক) কাজ আছে। যাঁরা এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।